মানজারেহাসীন মুরাদের একটি সাক্ষাৎকার

আমার ছবি অনেক বেশি ন্যারেটিভ
এই কথাটাতে ঠিক অতটা সায় নেই

মানজারেহাসীন মুরাদ। চলচ্চিত্র নির্মাতা। প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ, এর প্রচার, প্রসার ও প্রশিক্ষণে তার সক্রিয়তা বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের এই শক্তিশালী মাধ্যমের চর্চা বাড়িয়েছে শতগুণ। নবীন নির্মাতাদের নিকট ভরসার জন তিনি। সম্প্রতি তার চলচ্চিত্র চিন্তা, ডিজিটাল মাধ্যমের বিকাশ এবং বাংলাদেশে বিকল্প চলচ্চিত্র আন্দোলনের নানান দিক নিয়ে তার সাথে কথা বলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা ফৌজিয়া খান। তাদের কথোপকথন পাঠকের জন্য।

ফৌজিয়া খান: আমরা ছেলেবেলার প্রসঙ্গ দিয়েই শুরু করি?
মানজারেহাসীন মুরাদ: ছোট করেই বলি, আমার জন্ম তো রংপুরে। দাদার বাড়ি ছিল পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার। বাবা চাকরি সূত্রে ১৯৪৮ সালে পূর্ববঙ্গে আসেন। শিক্ষকতা করতেন রংপুর কারমাইকেল কলেজে। শহর থেকে দূরে- রেসিডেন্সিয়াল কলেজ। ঐতিহ্যবাহী একটা কলেজ- রংপুর কারমাইকেল কলেজ। তখন কলেজটা শহরের বাইরে ছিল- এখন শহরটা কলেজের বেশ কাছে চলে গেছে তখন এমন ছিল না। গত বছর (২০১১ সাল) গিয়ে দেখলাম- শহরটা সম্প্রসারিত হয়েছে। তখন ব্যাপারটা এমন ছিল যে, শহরে থেকে বেশ অনেকটা দূরে। ঢাকায় যেমন আছে না- জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি, শহর থেকে দূরে- রেসিডেনসিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো; তেমনই একটা কলেজ ছিল। ওর একটা নিজস্ব পরিমÐল ছিল। একদিকে শিক্ষকরা থাকতেন, অন্যদিকে কর্মচারিদের থাকার ব্যবস্থা ছিল; শিক্ষকরা থাকতেন ছোট ছোট বাংলোর মতোন বাড়িতে। আবার ছাত্র-ছাত্রীদের হোস্টেল ছিল।

ফৌজিয়া: মেয়েদের হোস্টেল ছিল?
মানজারেহাসীন মুরাদ: হ্যা ছিল। তখন ব্যাপারটা কিন্তু আমাদের বেশ আকর্ষণীয়ই মনে হতো। আবার আমাদের প্রত্যেকের বাসার সামনে বাগান করার মতোন জায়গা ছিল; কেউ কেউ বাসার সামনের জায়গাটাতে শাক-সবজি লাগাতেন। পেছনদিকেও বেশ বড় জায়গা ছিল- ওগুলো সব কলেজেরই জায়গা। যার যার বাসার আশপাশের জায়গা ঘেরাও দিয়ে চাষ করতেন, পেঁয়াজের চাষ করতেন, শাক-সবজি লাগাতেন; সামনের দিকে ফুলের বাগান করতেন।
রিকশা দিয়ে শহরে যাওয়া যেত- ঘণ্টাখানেক সময় লাগতো। স্কুলে যেতাম শহরে। মায়ের দিকের আত্মীয়-স্বজন অনেকে রংপুর শহরে থাকতেন। সুতরাং শহরের পরিবেশটাও আমাদের জানা ছিল- মানে (বিশ শতকের) ষাট দশকের বা পঞ্চাশের শেষের দিকের মফস্বল শহরের পরিবেশটাও চেনা ছিল। আবার একেবারে গ্রাম্য পরিবেশও অজানা ছিল না। কারণ আমাদের বাসা থেকে পাঁচ/সাত মিনিট হাঁটলেই গ্রাম পাওয়া যেত। একটা সাঁওতালপাড়া ছিল- আমার এক বাল্যবন্ধু ছিল সাঁওতাল; ওর নামটাও মনে আছে- শিবু। বেশ একটা অন্যরকম পরিবেশ। কারমাইকেল কলেজটা উত্তরঙ্গের অন্যতম প্রধান একটা কলেজ ছিল- যেমন পাবনা ছিল অ্যাডওয়ার্ড কলেজ। ফলে একটা ভালো সমৃদ্ধ কলেজের পরিবেশ পেয়েছিলাম। সবমিলিয়ে বেশ অন্যরকম একটা পরিবেশের মধ্যে বড় হয়েছি- একেবারে শহর না- আবার পুরোটা গ্রামও না।

ফৌজিয়া: ঢাকা এলেন কবে?
মানজারেহাসীন: ১৯৬৩ সালে ঢাকা এলাম। আমি তখন ক্লাশ ফাইভ পাশ করে গেছি। বছরের মাঝামাঝি এলাম বলে সিক্সে দু’বার পড়তে হয়েছে। ঢাকায় এসেও একটা অন্যরকম পরিবেশে পড়লাম। বাবা কলেজের চাকরি ছেড়ে বিসিএসআইআর মানে এখন বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণাগার যেটা- সেটা তখন ছিল ইস্ট পাকিস্তান সায়েন্টিফিক রিসার্স সেন্টার- ওখানে চাকরি নিয়ে এলেন। কাকতালীয়ভাবেই এখানেও এমন একটা জায়গায় এসে পড়লাম- ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থল হলেও বেশ খোলামেলা বড় জায়গা নিয়ে একটা প্রতিষ্ঠান এবং প্রতিষ্ঠানের যারা কর্মী তাদের থাকার ব্যবস্থাও এখানেই- রেসিডেন্সিয়াল এলাকা, কলোনী। বেশ ফাঁকা, খোলামেলা জায়গা- মাঠ ছিল, জঙ্গল ছিল, গাছপালা ছিল। একদিকে ধানমন্ডি, অন্যদিকে শাহবাগ। ঢাকায় এসে খুব যে অ্যালিয়েনেটেড ফিল করছি তা না। ধানমন্ডি লেকে সাঁতার কাটতে আসতাম, স্কুলে যেতাম। তবে পারতপক্ষে সাইন্স ল্যাবরেটরির ওই এলাকার বাইরে যেতাম না। ভাড়া বাড়িতে থাকতে হয়নি। মোটামুটিভাবে একটা পাড়ার মধ্যেই থাকা। সবাই সবাইকে চিনতেন ওই কলোনীর। এটা যেন রংপুর কারমাইকেল কলেজেরই ছোট একটা এক্সটেনশন ছিল। এক ধরনের বিচ্ছিন্ন একটা দ্বীপের মতোন। এখনো জায়গাটা সেরকমই আছে কিছুটা। আমরা পারতপক্ষে সাইন্স ল্যাবরেটরির বাইরে বেরুতাম না।

ফৌজিয়া: তারমানে একটা নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের মধ্যে বড় হওয়া?
মানজারেহাসীন: ঠিক তা নয়- সায়েন্স ল্যাবরেটরির ওই পাড়ায় সকল কর্মীর পরিবার থাকত। আমরা তো সকলের সাথেই মিশতাম। ঈদে সবার বাসায় যেতাম। যেটা একেবারে হয় নাই তখন- শ্রমিক শ্রেণীর সাথে কোনো যোগাযোগ তখন হয়ে উঠেনি। মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্তের যে নানা স্তর সেইসব মানুষের সাথে মেলামেশা হয়েছে- কারণ সবাই একই ক্যাম্পাসে থাকতাম।

ফৌজিয়া: কোন স্কুলে ভর্তি হলেন?
মানজারেহাসীন: তখন ঢাকায় সবচেয়ে নামকরা স্কুল ছিল ল্যাবরেটরি স্কুল। আমি পড়াশোনায় তেমন ভালো ছিলাম না। আর ক্লাশ সিক্সে ল্যাবরেটরি স্কুলে ভর্তি হওয়া যায়নি। প্রথমে ভর্তি হই লালবাগের কাছে ওয়েস্ট এন্ড স্কুলে। কিন্তু এর পাঁচ মাস পরেই ঢাকায় একটা নতুন স্কুল হলো- ধানমন্ডি বয়েজ হাই স্কুল, ধানমন্ডি সাতাশ নম্বর সড়কে। ক্লাশ সিক্স থেকে ছাত্র ভর্তি নেওয়া হলো- ওখানে ভর্তি হলাম ১৯৬৪ সালে। আমরা ধানমন্ডি বয়েজ হাই স্কুলের প্রথম ব্যাচের ছাত্র।

ফৌজিয়া: খারাপ ছাত্র ছিলেন?
মানজারেহাসীন: (হাসি)। খারাপ ছাত্র মানে আমি জীবনে কখনো ফার্স্ট হইনি। সেটা নিচের ক্লাশেও না, উপরের ক্লাশেও না। আর পড়াশোনার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ ছিল না।

ফৌজিয়া: কিন্তু আপনাকে তো আমি অনেক পড়তে দেখি?
মানজারেহাসীন: এই পড়ার ব্যাপারটা অনেক পরে তৈরি হয়েছে। ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে উঠার পর থেকে পড়ার ব্যাপারটা শুরু হয়েছে। যদিও আমাদের বাড়িতে পড়ার চল ছিল। আমার বাবা (আবদুল হক খন্দকার) পড়তেন, লিখতেন। আমার তখন পড়ার কোনো আগ্রহ ছিল না। বাবা গান গাইতেন, মূলত রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল গীতি, পুরোনো দিনের বাংলা গান। মাঝে মাঝে চেষ্টা করতেন আমাদের গাওয়াতে। আমার প্রচÐ বিরক্ত লাগত। মনে হতো যে, আমার উপর টর্চার করা হচ্ছে। আমার বোন গাইত, ছোট ভাই তবলা বাজাত। আমার ওগুলো অস্বস্তি লাগত।

ফৌজিয়া: ছোটবেলায় তাহলে কি ভালো লাগত আপনার?
মানজারেহাসীন: খেলা। কিছুটা সময় হকি খেলেছিলাম। হকিতে সেকেন্ড ডিভিশন পর্যন্ত গেছিলাম। স্টিকের কারণে হকিতে খুব মারামারি হয়। একটা ঘটনা মনে পড়ছে। তখন ক্লাশ টেনে পড়ি। আমি যে দলে খেলতাম- সেটা থার্ড ডিভিশন থেকে তখন সেকেন্ড ডিভিশনে উঠল। সেকেন্ড ডিভিশনে মোটামুটি ভালই খেলি। আশা আছে ফার্স্ট ডিভিশনে যাব। একদিন ঢাকা স্টেডিয়ামে খেলা হচ্ছে। রেফারির কি একটা সিদ্ধান্তে মারামারি লেগে গেল। একটা গোল নিয়ে গোলযোগ। যে গোলকিপারের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্তটা গেল, আমার এখনো মনে আছে- সে হকিস্টিকটা নিয়ে দৌড়ে এসে রেফারির সাথে কথা কাটাকাটি, এক পর্যায়ে মাথায় মারল বাড়ি। রেফারির কপাল ফেটে রক্ত বেরুচ্ছে। তারপর স্টিক নিয়ে যে যাকে মারতে পারে। তারপরে সম্ভবত একটা ম্যাচ খেলেছি- এরপর হকি খেলা বন্ধ।
১৯৬৯ সালের আরেকটা ঘটনা মনে পড়ছে। সার্জেন্ট জহুরুল হকের মৃত্যু। ওইদিনই জীবনে প্রথম রাজপথে মিছিল করি। শেখ কামাল মাঝে মাঝে আমাদের স্কুলে আসতেন। উনার একটা সাইকেল ছিল। ওটা চালিয়ে মাঝে মধ্যেই আমাদের স্কুলে আসতেন। এসে যে খুব রাজনৈতিক আলাপ করতেন তা না। তবে সার্জেন্ট জহুরুল হক যেদিন মারা গেলেন সেদিন শেখ কামালসহ আরো কয়েকজন স্কুলে এলে স্কুল ছুটি দিয়ে দিল। উনাদের নেতৃত্বে আমি প্রথম মিছিল করি।

ফৌজিয়া: ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিলেন কবে?
মানজারেহাসীন: ১৯৭০ সালে।

ফৌজিয়া: কোন কলেজে ভর্তি হলেন?
মানজারেহাসীন: আমি ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষ পড়ি নটরডেম কলেজে। নটরডেম কলেজ একটু অন্যধরনের কলেজ ছিল। সেজন্য তখন সেখানে কোনো সাংস্কৃতিক কর্মকাÐে যুক্ত হওয়ার সুযোগ হয় নাই। পরে ঢাকা কলেজে চলে আসি। এখানে এসে আমি সক্রিয়ভাবে রাজনীতির সাথে যুক্ত হই। সে ছাত্র রাজনীতির সুবাদেই কিছু কিছু সাংস্কৃতিক কর্মকাÐ আমাদের করতে হতো। তারমধ্যে একটা ছিল প্রকাশনা এবং প্রকাশনার কাজটা আমার কাছে বেশ আকর্ষণীয় লাগতো। যদিও খুব একটা লেখালেখি করা হয়নি তখন। এখনো যে লেখালেখি করি নিয়মিতভাবে সেটা কিন্তু না; করি খুবই বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্তভাবে। কোনো ধারাবাহিকতা নেই এতে। তো যা বলছিলাম, কলেজে রাজনীতি করার সুবাদে সেসব সাংস্কৃতিক কর্মকাÐের মধ্য দিয়ে আস্তে আস্তে আনন্দ পাচ্ছিলাম, এক ধরনের আকর্ষণ অনুভব করছিলাম। একটু কাকতালীয়ভাবেই বোধহয়, মাহবুবুল আলম আমাদের বন্ধু- দীর্ঘদিনের চলচ্চিত্র সংসদ কর্মী, চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখক- সমালোচক- তার সাথে পরিচয় হয়। আমাদের আরেক বন্ধু পরবর্তীকালে নাটকে কাজ করেছিল- বাংলাদেশ টেলিভিশনে কাজ করেছে, এখনও করে- সালেক খান। ও আমাদের শৈশবের বন্ধু। তার মাধ্যমে মাহবুবুল আলমের সাথে পরিচয় হয় এবং মাহবুবুল আলমের সূত্রেই সম্ভবত বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ-র প্রদর্শনীতে যাওয়া শুরু করি। সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুতে। ১৯৭২ সালের শেষদিকে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করি।

ফৌজিয়া: মুক্তিযুদ্ধের সময় কোথায় ছিলেন?
মানজারেহাসীন: ঢাকায়ই থাকতে হয়েছে। সায়েন্স ল্যাবরেটরির ওই কলোনীতেই ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শুরুর দিকে আর শেষের দিক ছাড়া আমাদের পাড়ায় তেমন কোনো অসুবিধা হয় নাই। আমরা কলোনীর ভেতরেই ছিলাম। পঁচিশে মার্চ রাতে পিলখানার গোলাগুলির শব্দ সব শুনেছি। ওই বয়সে বাবা-মায়ের মতের বাইরে যেতে পারিনি। যুদ্ধের পুরো সময়টাই কলোনীর ওই ক্যাম্পাসে কেটেছে।

ফৌজিয়া: এবার আমরা ফিল্ম প্রসঙ্গে আসি। ফিল্মে আগ্রহ হলো কেমন করে?
মানজারেহাসীন: এটা একটু কাকতালীয় বলতে হবে। কারণ ওইভাবে চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহ আমার কখনো ছিল না। অন্তত কলেজ জীবন পর্যন্ত ছিল না। স্বাধীনতার পরে ছায়ানটে শিক্ষার্থী হিসেবে যোগ দেয়া, সেটার মধ্যদিয়ে সাংস্কৃতিক পরিমÐলের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ তৈরি হয়েছিল। নটরডেম ছেড়ে যখন ঢাকা কলেজে ভর্তি হলাম- সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যোগ দিলাম। রাজনৈতিক কর্মকাÐের মধ্যদিয়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাÐে সম্পৃক্তি।
স্বাধীনতার পরে চলচ্চিচত্র সংসদ আন্দোলন বেগবান হতে শুরু করে- যেমন গ্রæপ থিয়েটার আন্দোলন বেগবান হতে শুরু করেছিল তখন; সেই সুবাদে ঢাকা শহরে এবং ঢাকার বাইরেও অনেক চলচ্চিত্র সংসদ সক্রিয় হয়ে উঠে।
তখনকার দিনে বামপন্থী রাজনীতির সাথে যারা যুক্ত ছিল- কিছুটা প্রগতিশীল মানুষ; তারা সংবাদ পত্রিকা পড়তেন। সংবাদ পত্রিকার সংস্কৃতি বিভাগ দেখতেন হারুন অর রশিদ। তিনিও একটি চলচ্চিত্র সংসদ করেছিলেন- উত্তরণ। নিজে যুক্ত ছিলেন বলেই চলচ্চিত্র সংসদের খবরাখবর নিয়মিত বেরুত সংবাদ-র পাতায়। সেসব খবর পড়তাম। চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার সেটাও বোধহয় একটা কারণ।
১৯৭২ সালের শেষদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। তখন শৈশবের বন্ধু সালেক খানের মাধ্যমে মাহবুবুল আলমের সাথে পরিচয় হয় এবং মাহবুবুল আলমের সূত্রেই সম্ভবত বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ-র প্রদর্শনীতে আসা শুরু করি। মাহবুবুল আলম- দীর্ঘদিনের চলচ্চিত্র সংসদ কর্মী, চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখক, সমালোচক। বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার আগে কিন্তু তেমনভাবে চলচ্চিত্র দেখা হয় নাই। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদে গিয়ে বেশ কিছু চলচ্চিত্র দেখার পর মনে হলো যে চলচ্চিত্র বেশ আকর্ষণীয় একটা শিল্প মাধ্যম। আমার দেখতে ভালো লাগছে।
তখন নিয়মিতভাবে কিছু ভারতীয় পত্রপত্রিকা আমাদের হাতে আসত। ম্যারিয়েটা বলে একটা ছোটো বইয়ের দোকান ছিল ঢাকা স্টেডিয়ামে- উনারা চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকা আনতেন। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ-রও একটা ছোট লাইব্রেরি ছিল। তখন আমরা নিয়মিতভাবে যে পত্রিকাটি পেতাম- বৃটিশ ফিল্ম ইন্সস্টিটিউট থেকে যেটা পাবলিশ হতো- সাইট এন্ড সাউন্ড; কোলকাতা থেকে আসত চিত্রবীক্ষণ, চিত্রকল্প, চিত্রভাষ; বোম্বে থেকে আসত স্ক্রিন। আলমগীর কবিরের একটি পত্রিকা ছিল- সিকোয়েন্স, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ-রও পত্রিকা ছিল- ধ্রুপদী। পরবর্তীতে প্রতিমাসে চলচ্চিত্র সংসদ থেকে বেরুতো চলচ্চিত্র বুলেটিন চলচ্চিত্রপত্র। কারণ ধ্রুপদী দীর্ঘ বিরতি দিয়ে প্রকাশিত হতো। এই সবকিছুর মধ্যদিয়ে চলচ্চিত্র সম্পর্কে একটা তাত্তি¡ক ধারণাও আস্তে আস্তে তৈরি হতে শুরু করে।
চলচ্চিত্র দেখার ব্যাপারটা আরো একটু বেগমান হয় একটি ঘটনার মধ্যদিয়ে। ভারতের ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন ইন্সস্টিউট অব ইন্ডিয়া-র ফিল্ম অ্যাপিসিয়েশন বিভাগের প্রধান ছিলেন সতীশ বাহাদুর। তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়- চলচ্চিত্র অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স করার জন্য। প্রচুর আগ্রহী অংশগ্রহণকারী ছিলেন- যারা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ-র সদস্য ছিলেন এবং অন্যান্য মাধ্যমের- সে চারুকলাই বলেন, সঙ্গীত বলেন, সাহিত্য বলেন, স্থাপত্য বলেন- এই সব মাধ্যমের তখন যারা সক্রিয় ব্যক্তিত্ব; তারা সবাই এই অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

ফৌজিয়া: ওটা কত সালের কথা?
মানজারেহাসীন: ১৯৭৪ সালে। আমাদের মতোন যারা নবীন- মানে চলচ্চিত্র সংসদে পরে যোগ দিয়েছিলাম তাদের পক্ষে ওই কোর্সে অংশগ্রহণ করার সুযোগ হয় নাই। দু’বছর পরে আরেকটি ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স- যেটি সতীশ বাহাদুর এবং আরেকজন অধ্যাপক ভারতের ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন ইন্সস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া-র – এই মূহূর্তে তার নাম মনে পড়ছে না- উনারা দ্বিতীয়বারের মতোন আসেন। তখন আমি চলচ্চিত্র অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পাই। ওটা আয়োজন করেছিল সায়েন্স সিনে ক্লাব। এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদভিত্তিক চলচ্চিত্র সংসদ ছিল। ওটা আয়োজন করেছিল সায়েন্স সিনে ক্লাব। এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদভিত্তিক চলচ্চিত্র সংসদ ছিল। এর সভাপ্রধান ছিলেন তখন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক এখনকার বিএনপিপন্থী রাজনীতিবিদ- মঈন খান। তো এইসব কর্মকাÐের মধ্য দিয়ে নিজেকে একভাবে প্রস্তুত করছিলাম। তাছাড়া তখন আমরা নিয়মিতভাবে বৃটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউট থেকে প্রকাশিত- সাইট এন্ড সাইন্ড পত্রিকাটি পেতাম, কোলকাতা থেকে আসত চিত্রবিক্ষণ, চিত্রকল্প, চিত্রভাষা; বোম্বে থেকে আসত স্ক্রিন। আলমগীর কবিরের একটি পত্রিকা ছিল- সিকোয়েন্স, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ-র পত্রিকা ছিল ধ্রæপদী। পরবর্তীতে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ থেকে প্রতিমাসে বেরুত চলচ্চিত্র বুলেটিন। চলচ্চিত্র বুলেটিন পরে আবার চলচ্চিত্রপত্র নামে প্রকাশিত হতে শুরু করল- ধ্রæপদী যেহেতু দীর্ঘ বিরতি দিয়ে প্রকাশিত হতো।
তো এইসব মিলিয়ে চলচ্চিত্রের প্রতি আস্তে আস্তে আকর্ষণ গাঢ় হতে শুরু করে। আকর্ষণ বলতে কি- চলচ্চিত্র দেখাতেই আনন্দ ছিল, তখনো ঠিক চলচ্চিত্র নির্মাণের কথা আমাদের মাথায় আসে নাই। চলচ্চিত্র নির্মাণের যে আয়োজন সেটা আমাদের পক্ষে কখোনো করা সম্ভব হবে সেটাও আমরা তখন ভাবতে পারি নাই। চলচ্চিত্র মাধ্যম দেখা, বোঝা- কেবলমাত্র দর্শক হিসেবে না, চলচ্চিত্র সংগঠন করা; এই ব্যাপারটি আমার বরাবরই ছিল। এখনো যেটা আছে যে সাংগঠনিক কাজে আমার বরাবরই একটা আগ্রহ আছে, করতে ভালো লাগে। চলচ্চিত্র সংসদের সাংগঠনিক কাজে অংশগ্রহণ করার একটা সুযোগ হয়েছিল। এই ধরনের সাংগঠনিক কাজ সবাই ঠিক করতে আগ্রহী হন না, সুতরাং ওটা আমার করার সুযোগও হয়েছিল। এর পাশাপাশি আরেকটা কথা না বললেই নয়, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সংস্কৃতি সংসদ- ষাটের দশকে এটি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। এটি প্রগতিশীল ছাত্রদের সাংস্কৃতিক সংগঠন। ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন ছিল এটা।এখন অবশ্য তার আর অস্তিত্ব নেই। মোটামুটিভাবে বলা যেতে পারে, আমদের সময় টিমটিম করে ওটা চলছিল। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরে বোধহয় দু’তিন বছর চলেছে- তারপর আর চলেনি সংস্কৃতি সংসদ। ষাট এবং সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে কিন্তু এই সংস্কৃতি সংসদ-র বিশেষ ভূমিকা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দিক সাংস্কৃতিক কর্মকাÐে- বিশেষত প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মকাÐ পরিচালনায়। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি যে ছাত্র সংগঠনটি করতাম- বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন। স্বাধীনতার পরে ডাকসু নির্বাচনে সেটি প্রথমবারের মতোন জয়লাভ করে। নাট্যচক্র নামে ডাকসুর উদ্যোগে একটি নাটকের দল প্রতিষ্ঠা করা হয়। বলা যেতে পারে, এই দলটির মধ্যদিয়েই গ্রæপ থিয়েটার আন্দোলনের সূচনা হয়ে ছিল- যদিও পরবর্তীতে নাটচক্র তার অগ্রণী ভূমিকাটি ধরে রাখতে পারেনি। নাট্যচক্রেও আমার একধরনের সক্রিয়তা ছিল। ম. হামিদ তখন নাট্যচক্রের প্রধান। প্রথম দিকে কাকতালীয়ভাবে তিনি ভেবেছিলেন যে আমি হয়তো অভিনয় করতে পারবো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে যে অভিনয়ের যে ট্যালেন্ট সেটা আমার নেই। এক পর্যায়ে নাট্যচক্রের জন্য আমি বেশ কিছু নাটকে আলোক সম্পাদনার কাজ করেছিলাম।

ফৌজিয়া: অভিনয়ের চেষ্টা করেছিলেন আপনি!
মানজারেহাসীন: চেষ্টা মানে আমার নিজের যে খুব ইচ্ছে ছিল তা না। যেহেতু তখন হামিদ ভাই বলেছেন এবং সেটা মানা করা যায় নাই- পরবর্তীতে দেখা গেছে দু’একটা রিহার্সালের পরেই আমাকে বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছে শেষ পর্যন্ত। এখন যেমন ক্যামেরার পেছনে তখনও তেমনি মঞ্চের পেছনের কাজই করতে হয়েছে। ওই সময়ে নাট্যচক্র-র যে নাটকটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ, জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল- সেটি জহির রায়হানের লেট দেয়ার বি লাইট-এর অ্যাডাপটেশন। আমি ওটার আলোক সম্পাতের কাজটি করেছিলাম। নানা ধরনের কর্মকাÐ করছিলাম- তারমধ্যে চলচ্চিত্র একটি ছিল । আস্তে আস্তে দেখা গেল চলচ্চিত্রই আমার সাংস্কৃতিক কর্মকাÐের প্রধান ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল।
১৯৭৪ সালের গোড়ার দিকে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হই। পার্টিরও সাংস্কৃতিক শাখায় আমাকে নানান রকম কাজ করতে হয়েছে। এখন যেমন রাজনৈতিক বা সামাজিক কর্মকাÐে চলচ্চিত্র প্রায়শই জায়গা করে নিতে পারে- তখন কিন্তু ব্যাপারটা এমন ছিল না। নানা কারণে, প্রদর্শনের কারিগরি আয়োজন করার অসুবিধার কারণে রাজনৈতিক কোনো সভা বা অনুষ্ঠানে চটজলদি কোনো চলচ্চিত্র দেখানো যেত না। এখন যেমন খুব সহজে এটা করা যায়। ফলে সঙ্গীত, নাটক, আবৃত্তির দলকে আনা এই কাজটি ছাত্র ইউনিয়নের হয়ে সাংগঠনিকভাবে আমি করতাম। সংস্কৃতি সংসদ থেকে আমরা জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের নবজীবনের গান-র একটা অ্যাডাপটেশন করেছিলাম। ওটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। ১৯৭২ সালে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে রক্তকরবী নাটকের মঞ্চায়ন হয়- আমি এর সাথে যুক্ত ছিলাম। এসব নানা ধরনের কাজের একটা অংশ মাত্র ছিল তখন চলচ্চিত্র।

ফৌজিয়া: বামপন্থী রাজনৈতিক মতাদর্শের সংগঠনে কেন গেলেন?
মানজারেহাসীন: একটা প্রধান কারণ কিউবার বিপ্লব। চে গুয়েভারা, ফিদেল ক্যাস্ট্রোর কিছু লেখা পড়েছি। আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে গেরিলা যুদ্ধের মধ্যদিয়ে। সুতরাং কিউবার বিপ্লবের প্রতি আকর্ষণ ছিল। কিউবার গেরিলা যুদ্ধও সমসাময়িক। সেজন্য সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়। আরেকটা কারণ ছিল যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং পরবর্তী সময় বিশ্বব্যাপী যে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন সেই আন্দোলন একটা বড় ভ‚মিকা পালন করেছিল দেশ-বিদেশের বামপন্থী শক্তিগুলো। যেমন অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক, ভিয়েতনাম- সবগুলো দেশেই বামপন্থী মতাদর্শ জয়ী হয়েছে। তৃতীয়ত, আমি মুক্তিযুদ্ধে যাইনি। স্বাধীনতার পর যুদ্ধে অংশ না নিতে পারাটা আমার জন্য খুব মানসিক পীড়ার কারণ হয়েছিল। একটা পর্যায়ে আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্তও ছিলাম। বাসা থেকে বেরুতাম না তেমন। ঠিক ওই সময় আমার এক স্কাউটের বন্ধু- পুরোনা ঢাকার ছেলে- (নামটা দিতে হবে………………………)। পড়ত সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে। ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। যুদ্ধ শেষে ঢাকায় ফিরে আমার সাথে দেখা করে। ও-ই বলল, বাসায় বসে থেকে কোনো লাভ হবে না। এখন তো বিধ্বস্ত দেশ- পুনর্গঠনের নানান রকম উদ্যোগ আছে; তুই এরসাথে যুক্ত হ। ও আমাকে নিয়ে গেল ঢাকা মেডিকেল কলেজে। মেডিকেল কলেজে তখন বিশৃঙ্খল অবস্থা। কারণ ওখানার নিম্ন পদস্থ কর্মীদের বড় একটা অংশ ছিলেন অবাঙালী। যুদ্ধ শেষে তারা তো আর ওখানে ছিল না। ওই জায়গাটা তখনও ফাঁকা। স্কাউটিংয়ে আমাদের ফার্স্ট এইডের ট্রেনিং ছিল। আমাদেরকে স্কাউটের পক্ষ থেকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল মূলত জরুরি বিভাগ এবং অন্য কিছু বিভাগে স্বেচ্ছাশ্রমে সেবা দেয়া। তিন/চার মাস প্রতিদিন কলেজ শেষে ঢাকা মেডিকেলে সেবা দিতে যেতাম। ওটার মধ্যদিয়ে মুক্তিযুদ্ধের একটা বীভৎস অভিজ্ঞতা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় যোগযোগ ব্যবস্থা না থাকায় এবং নিরাপত্তাহীনতার কারণে মানুষ চিকিৎসা নিতে পারেনি। যারা যুদ্ধে আহত হয়েছেন, গুলি লেগেছে, বেয়নটের আঘাতে হয়েছেন, আগুনে পুড়েছেন- এমন অসংখ্য মানুষ কোনোভাবে বেঁচেছিলেন তাদেরকে তখন ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে আসা শুরু হলো। কারো হয়ত পা পচে গেছে, হাত পচে গেছে, পিঠ পচে গেছে- এমনকি মাথার খুলি উড়ে গেছে; কী যে বীভৎস! এই জিনিসগুলো দেখতে দেখতে আবার আমার সামাজিক সম্পৃক্ততার প্রতি আগ্রহ শুরু হয়। সে সময় স্বাধীনতার আগে থেকেই ঢাকা মেডিকেলের ছাত্র সংসদে ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিনিধিত্ব ছিল বেশি। সেই কারণেই ঢাকা মেডিকেল কলেজে ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীর সংখ্যা বেশি ছিল। স্বেচ্ছাশ্রম দিতে গিয়ে তাদের কারো কারো সাথে পরিচয় হয়। তাদের মাধ্যমেই ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেই। ১৯৭২ সালে একুশে ফেব্রæয়ারি খুব জাকজমকভাবে সপ্তাহব্যাপী পালন করা হয়। ঢাকা শহর প্রথমবারের মতোন খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছিল। মূলত এই উদ্যোগটা নিয়েছিল ছাত্র ইউনিয়ন এবং কমিউনিস্ট পার্টি। আমি ঢাকা কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী। তখন আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে ওই সাজানোর কাজে যুক্ত হই। উনি ছিলেন হারুণ অর রশীদ। উনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ বর্ষে পড়তেন। সরাসরি গেরিলা যুদ্ধ করেছেন। তারসাথে ওই সাতদিন কাজ করার সূত্রে মানসিকভাবে প্রচÐ বল ফিরে পাই।

ফৌজিয়া: সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ কি আপনার ব্যক্তিজীবনে আলাদা কোনো মাত্রা যোগ করেছে?
মানজারেহাসীন: এটুকুই বলব যে, যদি আমার রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা না হতো তবে আমি এখন যে মানুষ- ভালো-মন্দ মিলিয়েই বলছি, সেই মানুষ হতে পারতাম না। এখন আমার জীবন সম্পর্কে যে অভিজ্ঞতা, দেশ সম্পর্কে ধারণা, শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে ধারণা, দেশের মানুষের প্রতি যে আকর্ষণ- এই সবকিছুর উৎস কিন্তু ওই রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা। যদিও আশির দশকের শেষ কিংবা নব্বই দশক থেকে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ সংকটকাল অতিক্রম করছে।

ফৌজিয়া: রাজনীতি থেকে আবার ফিল্মে ফিরে আসি। ফিল্ম বানাবার কথা কবে থেকে ভাবলেন?
মানজারেহাসীন: ফিল্ম বানানোর কথা খুব যে জোরেশোরে ভেবেছি- তা নয়। বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ আয়োজিত চলচ্চিত্র কর্মশালা শেষ করার পর থেকেই ভাবছিলাম, সরাসরি ফিল্ম না বানিয়ে যদি কোথাও পড়তে যাওয়া যায়। আমি এবং মোরশেদুল ইসলাম ভারতের ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন ইন্সস্টিটিউট থেকে স্কলারশিপ পাই ১৯৮৩ সালের শুরুতে। বাংলাদেশ সরকারের রিকমন্ডেশনসহ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অ্যাপ্লিকেশন পাঠাতে হবে। একটা ডেটলাইন ছিল। ঈদের ছুটি থাকায় সময়মতো পাঠানো গেল না অ্যাপ্লিকেশনটা। শেষ পর্যন্ত পুনায় যাওয়া হলো না।
১৯৮৩ সালেই ঢাকায় একটা চেক ফিল্ম উইক হয়েছিল। সেখানে চেক অ্যাম্বাসাডর ঘোষণা দিলেন, আমাদের তথ্য মন্ত্রণালয় যদি চলচ্চিত্র শিক্ষার জন্য কাউকে পাঠাতে চায় তবে ওরা বৃত্তি দেবে। ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজকে তখন এই সিলেকশনের দায়িত্বটা দেয়া হয়। আমিসহ আরো তিনজনকে নির্বাচন করা হয়। আমাদের কাগজপত্র চেকোশ্লোভাকিয়া পাঠানো হয়। দু’জনকে নির্বাচন করার কথা ছিল- কিন্তু ওখান থেকে আমাকে নির্বাচন করে। আমি তখন চেকোশ্লোভাকিয়া যাই- ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বরে। ফিল্ম ডিরেকশনে পড়তে যাই।
আমি তো গিয়েছিলাম ফিল্ম ডিরেকশন পড়তে। দেখলাম যে প্রায়শই আমাকে স্ক্রিপ্ট লিখতে হচ্ছে- ডায়ালগ লিখতে হচ্ছে। যেহেতু ভাষাটা ভালো জানি না- প্রায়শই ওটা লিখতে পারছি না। অ্যাসাইনমেন্ট দিতে কষ্ট হচ্ছে- তারপর কোনোরকমে চেক ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে কিছু সাহায্য নিয়ে ওটা লিখে যদিওবা জমা দিতাম- সেটা শিক্ষকের তেমন পছন্দ হচ্ছে না। এতে বেশ ডিস্টার্বড ছিলাম।
ওখানে গিয়ে দেখলাম আলাদা একটা বিভাগ আছে যেখানে ডকুমেন্টারি প্রডাকশন শেখানো হবে। আমাদের তো ইন্সস্টিটিউটে প্রতিদিন একটা করে স্ক্রিনিং হতো। নানা স্ক্রিনিং হতো নানান ডিপার্টমেন্টে। সময় থাকলে সেগুলো যে কেউ গিয়ে দেখতে পারে। তাছাড়া আমাদের একটা ক্লাব ছিল, একটা ছোট হল ছিল; ফিল্ম স্ক্রিনিং হতো। সেখানে প্রচুর সিনেমা দেখতাম। তখন এমন কিছু ডকুমেন্টারি ফিল্ম দেখি যা আগে কখনো দেখি নাই। তারফলে ডকুমেন্টারি ফিল্মের প্রতি একরকমের আগ্রহ তৈরি হলো। ফার্স্ট সেমিস্টারটা যখন শেষ করলাম তখন আমি মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি- ফিকশন আর কন্টিনিউ করব না। প্রথম বছর শেষ করার পরে আমি একটা অ্যাপ্লিকেশন লিখলাম শর্ট কোর্সে যাবার জন্যে। ওরা রাজি হয়ে গেল। আমার বছর নষ্ট হলো না- আমাকে সেকেন্ড ইয়ারে নিল। ওটা ছিল দু’বছরের কোর্স। আমার তো পাঁচ বছরের স্বলারশিপ ছিল। ওরা আমাকে বলল, তুমি চাইলে অন্য কোনো কোর্স নিতে পারো- পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন কোর্স। তখন আমি আমার ডিপ্লোমার বাইরে আরেকটা কোর্স করলাম- সেটা ছিল মূলত ডকুমেন্টারির থিওরি এবং এক ডিরেকটরের সাথে সহকারি হিসেবে কাজ করা। তো সবমিলিয়ে এটা একটা ডিপ্লোমা এবং পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ডিপ্লোমা। শেষ হয় ১৯৮৮ সালে। সেবছর আমি সেপ্টেম্বর দেশে ফিরে আসি।

ফৌজিয়া: এসে ছবি বানাতে শুরু করলেন?
মানজারেহাসীন: হ্যা, ফিরে এসে পেশাগতভাবে তো এটা নিতেই হবে। কিন্তু ডকুমেন্টারির চিত্রটা বাংলাদেশে কি, সম্ভাবনার জায়গাটা তখন আমার জানা ছিল না। জীবিকার জন্য অর্থ উপার্জন করতে হবে। তাই প্রথম যে কাজ করলাম, সাইদুল আনাম টুটুল- উনারা তখন বেশ সফলভাবে বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণ করেন। টুটুল ভাইয়ের সাথে যেহেতু আমাদের অনেকদিনের সম্পর্ক- পারিবারিকভাবেও ছিল, টুটুল ভাইকে বললাম। উনি আমাকে খুব বড় সহায়তা করেছিলেন। তখন তার হাতে অনেক কাজ, উনি খুব ব্যস্ত; উনি দুটি বিজ্ঞাপন নির্মাণের কাজ আমাকে দিয়েছিলেন। সেই দুটি কাজ করেছিলাম। তারপর ১৯৮৮ থেকে ’৯১ পর্যন্ত প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করিনি ওই অর্থে- যদিও কাজ শুরু করেছিলাম। পেশাগতভাবে বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণ করি। সুফিয়া কামালকে নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ শুরুটা হয়-১৯৮৯ সালে। একই সময়ে গ্যটে ইনস্টিটিউট- জার্মান কালচারাল সেন্টার এবং বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরাম একটা ওয়ার্কশপ করে, ফিল্ম প্রডাকশন ওয়ার্কশপ যেখানে জার্মানি থেকে ক্রিস্তভ উভনার এসেছিলেন। উনি আগেও এসেছিলেন ঢাকায়, দুটি ছবি বানিয়েছিলেন এখানে- ঢাকা টোকাই, ঢাকা রিক্সা নামে। ঢাকা টোকাই তো বেশ নাম করেছিল। তখন আরেকটা লম্বা ছবি বানানোর কথা ছিল- এক ঘণ্টার একটা ডকুমেন্টারি। ওটারই একটা ওয়ার্কশপে আমিও যোগ দিলাম। শেষ পর্যন্ত ওই ওয়ার্কশপে তিনজনের একটা ডিরেকটরিয়াল টিম তৈরি করা হলো; টিমে ছিলাম আমি, তারেক মাসুদ এবং তানভীর মোকাম্মেল। আমরা ছিলাম ডিরেকশনে, বেবী ইসলাম এবং মিশুক মুনীর ছিলেন ক্যামেরায়। ক্রিস্তভ উভনার ডিরেকটোরিয়াল অ্যাডভাইজার ছিলেন। শুটিং আমরা সকলে মিলেই করি- তানভীর, তারেক, আমি এবং ক্রিস্তভ। পরে তানভীর এবং তারেক বলল যে, তারা নিজেদের কাজ করবে- তারা আর এর সাথে যুক্ত হতে চায় না। পোস্ট প্রডাকশনের কাজ পুরুটাই আমি করেছি। আমাদের সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন সাজ্জাদ জহির। ১৬ মি.মিটারে ছবিটি নির্মিত হয়েছিল। প্রচুর শ্যুট করা হয়েছিল। বাজেটটা মোটামুটি রিজেনেবল ছিল। প্রায় দেড় বছরের উপরে এডিট করি। সিঙ্ক সাউন্ড রেকর্ডিংয়ে কিছু সমস্যা ছিল- ফিল্ম স্পিডে গÐগোল ছিল। সিঙ্ক করাটা খুব মুশকিল হয়েছিল। ফ্রেম কেটে কেটে সিঙ্ক করতে হতো। এটা সাংঘাতিক সময় সাপেক্ষ এবং বেশ বিরক্তিকর একটা কাজ ছিল। সৌভাগ্য যে সাজ্জাদ জহির এটা খুব ধৈর্য নিয়ে করতে পেরেছিলেন। তখন আমাদের সাথে দু’জন সহকারি পরিচালক ছিলেন- তারেক শাহরিয়ার এবং জুনায়েদ হালিম। আরেকজন ছিলেন- যদিও ও এখন আর ছবি বানানোর সাথে যুক্ত নাই- কাওসার জাহান খান। তখন ১৬ মি.মি. একটা এডিটিং টেবিল ছিল বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভে। এখন যেটা গণভবন তার পেছনদিকটায় ছিল ফিল্ম আর্কাইভ। ওখানে আমরা এডিট করতাম। একই সময়ে তারেক মাসুদ তার আদমসুরত ছবির এডিটিং শুরু করে। তখন ওই একটাই জায়গা ছিল- সবাই এডিট করতাম ওখানেই। তারেক আমাদের এই ছবিতেও ছিল- প্রচুর দিন গেছে যে আমরা আমাদের এডিট না করে ওই ছবির শিফট দিয়েছি। তখন তারেক এবং ক্যাথেরিনের প্রণয় চলছিল। তখনও তারা বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করেনি। যাইহোক, শেষ পর্যন্ত ওই ছবিটি (কৃষ্ণনগরে একদিন) শেষ হয় ১৯৯৩ সালে। এটি ম্যানহেইম চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছিল। ছবিটি ঢাকায় একবার সম্পাদনা হবার পর ক্রিস্তভ উভনারকে জার্মানীতে পাঠানো হয়েছিল। উনি কিছু সাজেশন দিয়েছিলেন- তার ভিত্তিতে আবার আমরা এডিট করি। জার্মানিতে এর একটা প্রিন্ট হয়েছিল। ম্যানহেইম এবং জার্মানির আরো দুটি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল এবং ঢাকার আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয়েছিল। আমার মনে হয়েছে বেশ একটা ইন্টারেস্টিং কাজ হয়েছে ওটা।
ওই সময়েই আমরা প্রামাণ্যকার নামে একটা সংগঠন করি। আমরা তখন চিন্তা করছিলাম প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করা যায় কিভাবে। সংগঠনে প্রথমদিকে যুক্ত হয়েছিল সাজ্জাদ জহির, মাকসুদুল বারী এবং মোহাম্মদ মিজান- অডিওভিজ্যুয়ালে কাজ করেন- এভিকম বলে একটা প্রতিষ্ঠান আছে তার। অশোক ঘোষ বলে আরেকজন ছিলেন- এখন বিজ্ঞাপন ব্যবসায়ী। এরা সবাই প্রামাণ্যচিত্রের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। প্রথমে ভাবলাম, আমরা একটা প্রামাণ্যচিত্র নিমার্ণ করব। আমরা বিষয় নির্বাচনের চেষ্টা করছি। তখন ওয়াহিদুল হক সাহেব আমাদেরকে বললেন- তোমরা সুফিয়া খালাম্মার (সুফিয়া কামাল) উপর একটি ছবি বানাও। ওই অর্থে খালাম্মার সাথে আমাদের পরিচয় ছিল না। ওয়াহিদুল হক একদিন আমাকে নিয়ে গেলেন। তখন আমরা সুফিয়া কামালের কাজটা শুরু করি- ৩৫ মিলিমিটারে। কাকতালীয়ভাবে ৩৫ মি.মিটারের এই সিদ্ধান্তটা হয়েছিল। কারণ তখন সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী ছিলেন এফডিসির অপারেটিভ ডিরেকটর। উনি আমাদেরকে বলেছিলেন যে তোমরা ৩৫ মি.মিটারে করো- কারণ তাহলে আমি কিছু সহায়তা করতে পারব। এফডিসির প্রডিউসারদের কাছ থেকে কিছু র স্টক কালেক্ট করে দিতে পারব, এফডিসিতে পরিস্ফুটন এবং অন্যান্য কাজে সহায়তা করতে পারব। অল্প কিছু সহায়তা আমরা পেয়েছিলাম ওখান থেকে। শেষ পর্যন্ত ছবিটি ২০০৪ সালে শেষ হলো। মাঝখানে কোনো কাজ হয় নাই ওই ছবির। কৃষ্ণনগরে একদিন আর সুফিয়া কামালকে নিয়ে করা অপরাজিতা- পাশাপাশি দুটি কাজই শুরু হয়েছিল, কিন্তু দুটো কাজই বেশ সময় নিয়ে নিয়েছিল।

ফৌজিয়া: এটা কি ফিল্ম ফরম্যাটে কাজ করছিলেন বলে?
মানজারেহাসীন: ফরম্যাটের কারণে কিছুটা। কৃষ্ণনগরে একদিন তো কারিগরি একটা ত্রæটির ব্যাপার ছিল। ট্রান্সলেট করে জার্মানিতে পাঠানো, জার্মানিতে ওরা দেখে, ওদের ফিডব্যাক নেয়া- এটা তো এখনকার মতোন সহজ ছিল না; সুতরাং এটি সময় নিয়ে নিয়েছিল। আরেকটি বিষয় হচ্ছে যে, আমরা একা পড়ে গেছিলাম- আমার সঙ্গেকার অন্য দুই পরিচালক আর এই প্রজেক্টে ইনভলবড ছিলেন না- সেটাও দেরি হওয়ার একটা কারণ। আমি আবার সুফিয়া কামালের কাজটা নিয়ে কিছুটা ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম- অর্থ উপার্জনের কাজেও ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। এক পর্যায়ে অবশ্য অর্থ উপার্জনে কিছুটা সফল হয়েছিলাম- বলা যেতে পারে যে বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণে। বিজ্ঞাপনচিত্রে একটা সুবিধা আছে নগদ টাকাটা পাওয়া যায়। সেটা একটা ভালো দিক আর কি। কিন্তু কিছুটা যেমন বুঝতেও পারছিলাম যে এই মাধ্যমে বেশিদিন আমি কাজ করতে পারব না। শেষের দিকে দু’একটি বিজ্ঞাপন বেশ জনপ্রিয়ও হয়েছিল। পরবর্তীকালে মনে হয়েছিল যে এই মাধ্যমটা ঠিক আমার জন্য না। যে ধরনের ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরী করতে হয় বিজ্ঞাপনের কাজ চালাবার জন্যে- অনেক মানুষকে ইনভলব করতে হয়, ওটা বেশ ব্যয়সাপেক্ষ; সেটা আমি ঠিক চাচ্ছিলাম না আর সুযোগও ছিল না। কিছুদিন প্রিন্টিং প্রেসে কাজ করি। তারপর থেকে পূর্ণকালীন চলচ্চিত্র নির্মাণে আসলাম। এরপরে আমি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কাজ পেলাম একটা- বিল ডাকাতিয়ার কথা। ওটা পাওয়ার পর মনে হলো যে আমি যে বিষয়ে কাজ করতে চাই তার কাছাকাছি কাজ পাওয়া গেছে।

ফৌজিয়া: এবার বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র আন্দোলন নিয়ে কথা বলতে চাইছি। বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরাম বলতে বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র আন্দোলন এমন একটা ভাবনা তৈরি হয়েছে আমাদের এখানে। বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরাম তো হলো ১৯৮৬ সালে। শুরু থেকেই এর সাথে ছিলেন আপনি?
মানজারেহাসীন: ফোরাম যখন হয় তখন আমি চেকোশ্লোভাকিয়া পড়ছিলাম। ফোরামের ব্যাপারে প্রাথমিক আলোচনা করার একটা সুযোগ হয়েছিল। তখন তানভীর মোকাম্মেল তার ছবি নিয়ে পোল্যান্ডে একটা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে গেছে । ওখান থেকে ও প্রাগে আমার কাছে বেড়াতে এসেছিল। তার আগে ঢাকায় প্রথম মিটিং হয়েছিল- যেখানে এ-রকম একটা সংগঠন করার কথা আলোচনা হয়েছিল। তারপরে তানভীরের সাথে আমার আলোচনা হয় প্রাগে। ওখান থেকে ফেরত আসার পরে এখানে ঘোষণাটা দেয় এবং সেখানে আমার নামও সংযুক্ত করে।

ফৌজিয়া: আপনি তাহলে এই আন্দোলনের সাথে সরাসরি যুক্ত হলেন কবে থেকে?
মানজারেহাসীন: আমি তো চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের মধ্যে ছিলামই। এর মধ্য দিয়ে যে ভাবনা আমাদের শুরুতেই ছিল- আমরা কি কেবলমাত্র বাইরের ছবিই দেখবো, দেশ-বিদেশের ছবি দেখে অভিজ্ঞতা নেব, আমাদের রুচি উন্নত করব! নাকি এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের ব্যাপারটাকেও এগিয়ে নিতে চেষ্টা করব? এটা নিয়ে দ্ব›দ্ব কিন্তু সবসময় চলচ্চিত্র সংসদগুলোর মধ্যে ছিল- অন্তত তখন ছিল; এখন অবশ্য কমে এসেছে দ্ব›দ্বটা।
চলচ্চিত্র সংসদের মধ্য থেকে যখনি কেউ কিছু বানাতে গেছে- তখন একটা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। আগামী (পরিচালনা: মোরশেদুল ইসলাম), হুলিয়া (পরিচালনা: তানভীর মোকাম্মেল) ছবিগুলো বানানোর মধ্য দিয়ে দেখা গেল যে ইনডিভিজুয়ালি এইসব ছবি তৈরি করা যায়। কিন্তু আমাদের দেশে চলচ্চিত্রের উপর সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় যে অনুশাসনগুলো আছে- সেগুলো একলা মোকাবেলা করা যায় না। সেই সময়- আমি মধ্য আশির কথা বলছি, তখন কিন্তু একে অন্যকে সহায়তার ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেই উপলব্ধি থেকেই এই ধারার নির্মাতাদের একত্রিত হবার প্রয়োজন দেখা দেয়। একটা সংগঠনের আওতায় এসে তাদের সম্মিলিত কথা এবং সেই শক্তিটাকে ব্যবহারের চেষ্টা দেখা গেল এবং তারই মধ্যদিয়ে বাংলাদেশে বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র আন্দোলন শুরু হলো ।
আমি সবসময়ই বলি, যে স্পিরিটে আমরা বিকল্প চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চেয়েছি সেটি কিন্তু শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়। যদি জহির রায়হানের স্টপ জেনোসাইডকে আমরা বিবেচনা করি তাহলে দেখব যে তার বিষয়, তার এক্সপ্রেশন, সেটা বানাবার যে প্রক্রিয়া- তার সবই কিন্তু বিকল্প ধারার । আমাদের এখনকার বিকল্প চলচ্চিত্র আন্দোলনের যে ভাবনা সেটা স্টপ জেনোসাইড-এ আছে। কিন্তু ওটি কোনো আন্দোলনের জন্ম দিতে পারেনি। কারণ তখন ওটি একটি ইনডিভিজ্যুয়াল চলচ্চিত্র প্রয়াস হিসেবে ছিল। আমি আমার দু-একটা লেখায় লিখেছি, বিকল্প ধারার প্রথম চলচ্চিত্র হচ্ছে স্টপ জেনোসাইড। আর বিকল্প ধারার আন্দোলনের প্রথম চলচ্চিত্র হলো আগামী এবং হুলিয়া।
দ্বিতীয় যে বিষয়টা বলা দরকার, বিকল্প বলতে কি এবং কিসের বিকল্প? বিকল্প বলতে আমরা কিন্তু বলেছিলাম, যে বিষয়গুলো চলচ্চিত্রের কাছে প্রত্যাশা করি বা উন্নত শিল্প-প্রডাক্টের কাছে প্রত্যাশা করি- সেটা কি? সেটি হলো- সমসাময়িক বাস্তবতা এবং সেই বাস্তবতার ধারণা বিশ্লেষণ দর্শকের কাছে তুলে ধরা। চলচ্চিত্র হবে এমন শিল্প যা মানুষের ভাবনা উজ্জ্বীবিত করবে, বোধকে আরো বেশি করে জাগ্রত করবে, ইতি এবং নেতির পার্থক্যটা আরো সচতেনভাবে সামনে আনবে, মানুষকে ভবিষ্যতমুখি স্বপ্ন দেখতে সহায়তা করবে, মানুষকে তার সময়কার বাস্তবতা ডকুমেন্টেশনে সহায়তা করবে। সেটা খালি সিনেমা না, সাহিত্য এবং অন্যান্য শিল্পমাধ্যমেও কিন্তু তা-ই হয়। এই জিনিসগুলো আমাদের সিনেমা থেকে অনুপস্থিত হতে হতে এমন একটা জায়গায় গিয়ে ঠেকেছিল- যেখানে সিনেমা কেবলমাত্র কিছু অডিও-ভিজ্যুয়াল রিপ্রডাকশনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেটা রিপ্রেজেন্টেশন না বলে বলা ভালো বিকৃত উপস্থাপনা। তার মধ্য দিয়ে একটি জিনিসই করা হয়েছে- সস্তা বিকৃত রুচির আনন্দ। আনন্দও আমি বলব না; সত্যজিৎ রায়ের সম্ভবত গুপী গায়েন বাঘা বায়েন ছবিতে একটা কথা ছিল- একটা ডায়ালগ। গুপী বলছে, আমাদের গান শুনে আপনারা আনন্দ পাবেন। বাঘা বলছে, আনন্দ না, আনন্দ না- ফূর্তি। আনন্দ এবং ফূর্তি- উনি কিন্তু খুব ভেবেচিন্তে এই শব্দ দুটি বসিয়েছিলেন । ফূর্তি সবসময়ই খুব সাময়িক। যে পজিটিভ ইমপ্যাক্ট আমরা চাই শিল্পের কাছ থেকে- ফূর্তি কিন্তু সেইটা দেয় না। কথার কথা, আজকাল প্রায়ই দেখি ছাদের উপর বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে। সেখানে খুব জোরে গান বাজিয়ে যে নাচানাচি করছে- ওখানে মানুষ এক ধরনের আনন্দ পায়। কিন্তু সেই আনন্দটা এক ধরনের ফূর্তি। তাৎক্ষণিক উত্তেজনার বাইরে ওটার আর কিছু নেই। ওই সময়টা সে হয়তো ভালোভাবেই কাটায়। সেটা কিন্তু মানসিক প্রশান্তির- কি বলব মানসিক একটা পজিটিভ অনুভবের জায়গায় নিয়ে যায় না। আনন্দ হয়তো এর চাইতে একটু বেশি কিছু।
আমাদের চলচ্চিত্র- মূলধারার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র অনেক বেশি করে এক ধরনের ক্ষণিক উত্তেজনা এবং ফূর্তির জায়গাটায় চলে গেছে। পুঁজির কারণে, তার টেকনোলজির কারণে, সরকারের হস্তক্ষেপ, সেন্সরশিপ- এই সমস্ত কারণে ওই চলচ্চিত্রগুলো ওরকম হতে বাধ্য হয়েছে। সেই জায়গা থেকে চলচ্চিত্রকে ফিরিয়ে আনার যে উদ্যোগটা- সেটাই কিন্তু আমাদের বিকল্প চলচ্চিত্র। ওইসব বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের বিকল্প যেসব বিষয় ওই চলচ্চিত্রে নাই বা থাকা সম্ভব না নানাবিধ কারণে- সেই অনুষঙ্গগুলো যদি দুর্বল করে দেয়া যায় তবে হয়ত সৃজনশীলতা চর্চার মাধ্যম হিসেবে আমাদের কাক্সিক্ষত চলচ্চিত্র নির্মাণ করা সম্ভব হবে। এমন স্বপ্ন থেকেই কিন্তু বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র আন্দোলন শুরু করেছিলাম আমরা।

ফৌজিয়া: পঁচিশ বছর পর বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র আন্দোলন নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কিরকম?
মানজারেহাসীন: একেক দেশে বিকল্প চলচ্চিত্রের একেক ধরনের লক্ষ্য থাকে। আবার হয়ত কমন বন্ডিংসও আছে যেটা দিয়ে আপনি আইভেন্টিফাই করতে পারবেন- এটা ওই দেশের চলচ্চিত্র। আমাদের বিকল্প চলচ্চিত্রের সাথে এর হয়ত কিছু মিল আছে, এক ধরনের ইউনিভার্সাল আইডেন্টিও হয়তো খুঁজে পাবেন। সেইভাবেই আমরা তখন বিকল্পধারার আন্দোলন শুরুর সময় চিন্তা করেছিলাম। এর একটা ইমপ্যাক্টও কিন্তু তৈরি হয়েছে। বড় ইমপ্যাক্ট হচ্ছে প্রথাগত চলচ্চিত্র নির্মাণের ইনফ্রাসট্রাকচারের বাইরে এসে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা গেছে। আমাদের আগে যারা ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গেছেন তাঁরা ওই মূলধারা প্রডাকশন এবং প্রদর্শন সিস্টেমের মধ্য দিয়েই করেছেন। শেষ পর্যন্ত ছবিটা হয়তো তৈরি হয়েছে, কিন্তু ছবিটা যে পরিমাণে দর্শকের কাছে আসবার কথা সেটা আসতে পারে নাই। আমরা বিকল্প ব্যবস্থায় ছবি নির্মাণ ও প্রদর্শন করতে পেরেছি। এটা আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন।
বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম হয়েছে- ১৯৮৬ সালে। প্রত্যেকটা আন্দোলনে কিন্তু একটা তাৎক্ষণিক প্রয়োজনকে অ্যাড্রেস করে কিছু করা হয় আর কিছু লং টার্ম অবজেক্টিভস থাকে। আমরা বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরাম-র মধ্যদিয়ে তাৎক্ষণিক প্রয়োজনকে খুব ইফেক্টিভলি অ্যাড্রেস করতে পেরেছি। কিন্তু ওভার দ্য ইয়ারস একটা আন্দোলনে নিজেদেরকে মোর ইফেক্টিভ করবার জন্যে যে নতুন নতুন মাত্রা যোগ করতে হয়, এটাকে সচল রাখতে হয়, একে সজীব রাখতে হয়- সেইটি হয়তো আমরা করতে পারি নাই। আমাদের প্রধান প্রধান নির্মাতা-সংগঠকেরা অনেক বেশি করে প্রফেশনাল বিষয়ের দিকে ঝুঁকে গেছি। তার ফলে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে নানাভাবে আমাদেরকে ক¤েপ্রামাইজ করতে হয়েছে। অনেক বেশি করে আমরা বাণিজ্যিক ধারা বা মূলধারার অনুষঙ্গকে গ্রহণ করেছি। ছবির বিষয়ের মধ্যে ততটা না- কিন্তু প্রডাকশন সিস্টেমের মধ্যে। আমরা অনেক বেশি করে বাজেট মুখাপেক্ষী হয়ে উঠেছি। সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে আমাদের ইনোভেটিভনেস না বাড়িয়ে টেকনোলজি বেশি করে ব্যবহার করতে চেয়েছি। টেকনোলজি পেতে গিয়ে বাজেট বাড়ছে, সেটা আবার সৃজনশীলভাবে ব্যবহার করতে পারছি না। সবমিলে আস্তে আস্তে এই জিনিসটা হয়েছে।
আরেকটা বড় ব্যাপার, আমরা আমাদের ধারার আন্দোলনের কোনো শৈল্পিক প্রকাশভঙ্গি প্রতিষ্ঠা করতে পারি নাই, অ্যাসথেটিক কোনো কমন ল্যাঙগুয়েজ নাই- যেটা ডিসটিংক্টটিভলি অন্যদের থেকে আমাদের আলাদা করে দিবে। তার ফলে আমাদের ধারার যারা সূচনাকারী-পাইওনিয়ার ফিল্মমেকার- তারাই এক সময় বলেছেন যে বিকল্প বলে কোনো কিছু নাই, পাবলিকলি বলেছেন। কোনো সময় এমনও উচ্চারিত হয়েছে যে বিকল্প ধারা ক্রমশ মূলধারায় রূপান্তরিত হবে। এটা তো কোনো দেশে হয়নি, হওয়ার মতোনও না। বিকল্প ধারাটা সব সময়ই একটা আভা গাঁর্দ ধারা। এই আভা গাঁর্দ ধারাটা যত সক্রিয় থাকবে তত বেশি করে মূলধারা পাল্টাতে থাকবে। আভা গাঁর্দ কখনো শেষ হবে না, মূলধারাও কখোনো শেষ হবে না; এটা পৃথিবীর কোনো দেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে হয়নি। বাণিজ্যিক ধারা বাণিজ্যিক ধারার মতোই আছে এবং সেটাই সবচেয়ে বেগবান ধারা- সব অর্থে- আর্থিকভাবে, প্রভাবের দিক থেকে। একটা শক্তিশালী বিকল্পধারার উপস্থিতি কিন্তু বাণিজ্যিক ধারাটাকে আস্তে আস্তে প্রভাবিত করে, করতে বাধ্য। শুনতে খুব ভালো লাগে যে হ্যাঁ, একদিন বিকল্প ধারাই মূলধারায় পরিণত হবে, খুব অপটিমিস্টিক একটা বিষয়। কিন্তু আসলে এটা খুব বাস্তবসস্মত চিন্তা নয়। তার ফলে আমরাই একধরনের বিভ্রান্তি তৈরি করেছি। আস্তে আস্তে আবার সেটা কাটছে- এটা একটা ভালো দিক যে এই উপলব্ধিটা তৈরি হচ্ছে।
যেকোনো আন্দোলনের চড়াই-উৎরাই তো থাকে। এখন হয়তো সেই চড়াই-উৎরাইয়ের একটা পর্ব যাচ্ছে। সংগঠনগতভাবে বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরাম থাকবে কি থাকবে না- সেটা অন্য প্রশ্ন, সেটা একটা সাংগঠনিক প্রশ্ন এবং যারা এরসাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত তাদের কর্মকাÐ এবং সৃজনশীল সাংগঠনিক প্রচেষ্টার উপর নির্ভর করবে। কিন্তু ভাবনাগতভাবে আমার মনে হয় এই ভাবনার গুরুত্ব অনেক। ভাবনাটার প্রাসঙ্গিকতা তো শেষ হয়ে যায় নাই। সাংগঠনিকভাবে বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরাম তত সচল বা প্রভাব বিস্তারকারী না থাকলেও ওই ভাবনাটা নিয়ে অন্য কাজ করতে পারে। একান্ত ব্যক্তিগতভাবেও কাজ করতে পারে, আবার সাংগঠনিকভাবে যৌথ উদ্যোগের মধ্যদিয়েও করতে পারে।

ফৌজিয়া: বিশ্বের অন্যান্য দেশে বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র আন্দেলনের সাথে আমাদের দেশের বিকল্প ধারার কোনো তুলনা করা চলে কি?
মানজারেহাসীন: কমপেয়ার করাটা মুশকিল। চলচ্চিত্র নির্মাণ- বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণের ব্যাপারটা কেবলমাত্র অর্থনৈতিক কিংবা কারিগরি ব্যাপার নয়। এর সাথে সামাজিক প্রশ্নটাও অনেক বেশি করে যুক্ত। এখন ধরেন যে আফ্রিকার মতো দেশে বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র হয়ত নেই কিন্তু আবার ওসমান স্যামবেনেগানের ছবির মূল ভাবনাটা কিন্তু বিকল্প ধারা প্রসূত। অ্যাডভান্সড কান্ট্রিগুলোতেও কিন্তু একটা ধারা আছে- ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম। ইন্ডিপেন্ডেন্ট অব হোয়াট? ইন্ডিপেন্ডেন্স ফ্রম দ্য টাইরানি অব ইনভেস্টমেন্ট, মার্কেট, পুঁজি- যেখানে হয়তো সৃজনশীলতাকে ঠিক সেইভাবে প্রাধান্য দেয়া হয় না বা ততটুকু প্রধান্য দেয়া হয় যেটা অনেক বড় গোষ্ঠিকে কাভার করতে পারে। এটা এক্সপ্রেশনের দিক থেকে হয়ত নতুন চলচ্চিত্র ভাষার প্রকাশকে ততটা উৎসাহিত করে না। বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রেও- বাণিজ্যিক ছবি যেমন এক ধরনের নিরাপদ বিষয়কে যা তেমনভাবে কোনো বড় জনগোষ্ঠিকে অফেন্ড করবে না বা সরকার অথবা পাওয়ারফুল গ্রæপকে অফেন্ড করবে না- তেমন বিষয় নিয়ে কাজ করে। একেক দেশে বিকল্প চলচ্চিত্রের ভাবনা একেক রকম। প্রথমদিকে আমাদের বন্ধুরা বলার চেষ্টা করেছে যে আমাদের দেশেই কেবলমাত্র বিকল্প চলচ্চিত্র করছি। কিন্তু তা তো ঠিক না। ধরেন ওইভাবে দেখতে গেলে আমেরিকাতেও চার্চে চলচ্চিত্র দেখানো হয়েছে, বেসমেন্টে চলচ্চিত্র দেখানো হয়েছে। ল্যাটিন আমেরিকায় ষাট সালে জঙ্গলে গেরিলাদের ক্যাম্পে চলচ্চিত্র দেখানো হয়েছে। আমরা তো বড়জোর বলাকাতে না দেখিয়ে পাবলিক লাইব্রেরিতে দেখিয়েছি। আমাদের কেউ কেউ কিছু ছবি গ্রামে-গঞ্জেও দেখিয়েছি। সুতরাং এইভাবে আত্মতৃপ্তির কোনো অবকাশ আছে বলে আমার মনে হয় না। হয়তো ওই সমস্ত দেশের চলচ্চিত্র সম্পর্কে খোঁজ আমাদের জানা নাই, আমাদের জানাশোনার অভাব ছিল। সেই জন্যে আমরা ভেবেছি আমরাই বিকল্প চলচ্চিত্র আন্দোলন করছি।
আবার কোনো কোনো দেশে বিকল্প চলচ্চিত্রের ভাবনাটাই কিন্তু নাই। প্রথমদিকে যারা ভারত থেকে আমাদের শর্ট ফিল্ম ফোরামের ফেস্টিভ্যালে এসেছিল- তারা ঠিক বিকল্প চলচ্চিত্রের ভাবনাটাকে গ্রহণও করতে পারে নাই। কিন্তু আবার দেখা গেছে কেরালায় জন আব্রাহামরা আমাদের কাছাকাছি আন্দোলন করেছেন। আমরা সৌভাগ্যবান এই অর্থে যে এই ধরনের একটা ধারা আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলাম এবং সেই ধারায় নির্মিত ছবিগুলো চলচ্চিত্র মাধ্যমের প্রতি আগ্রহী মানুষের কাছে স্বীকৃতি পেয়েছে। কিছু কিছু চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে যেগুলো অন্তত কিছু মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। এটা হচ্ছে পজিটিভ দিক। একবার যখন এই ধারাটি শুরু হয়েছে তখন এর মৃত্যু ঘটানোর কিছু নাই। আমরা যারা চলচ্চিত্রের সাথে এই ভাবনাগুলোকে সম্পৃক্ত করতে চাই তারা যদি ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগতভাবে এই ভাবনার চর্চা অব্যাহত রাখি এবং প্রতিনিয়ত বাস্তবতার সাথে আপগ্রেডেড করি নিজেদের তাহলেই এই ধারা বেগবান থাকবে। একটা প্রভাবশালী ধারা তৈরি হবে। এখন প্রয়োজন হলো এর প্রভাবটাকে কেমন করে আরো স্ট্রং করা যায় সেটা ভাবা। প্রথম কাজ হচ্ছে, নতুন নতুন ইনোভেটিভ ভালো এবং বিষয়ের দিক থেকে বৈচিত্র আছে এমন ছবি তৈরি করা। যেখানে সামাজিক-রাজনৈতিক স্বচ্ছ ভাবনার একটা প্রকাশ থাকবে। এটা কাহিনীচিত্রে হতে পারে, প্রামাণ্যচিত্রে হতে পারে, নিরীক্ষাধর্মী ছবি হতে পারে বা এই সমস্ত কাহিনীচিত্র প্রামাণ্যচিত্রের মধ্যে নিরীক্ষার ব্যাপারটি আসতে পারে। আমার তো মনে হয় আমাদের বিকল্প ধারা চলচ্চিত্র প্রকাশভঙ্গীর দিক থেকে আরো বেশি নিরীক্ষার দিকে যাওয়া দরকার। কারণ আমরা তো অনেক ম্যাস অডিয়েন্সের কথা চিন্তা করছি না যে অডিয়েন্সকে আমাদের সন্তুষ্ট করতে হবে। আমরা যদি একটা অ্যাডভান্সড অডিয়েন্সের কথা চিন্তা করি- সেই অডিয়েন্সের জন্য কিন্তু আরো বেশি নিরীক্ষার প্রয়োজন আছে। সেটা যদি আমরা সাকসেসফুলি করতে পারি তবে সাধারণ চলচ্চিত্রেও তার প্রভাব আস্তে আস্তে পড়বে। এটা একটা ইনডাকশন প্রসেসের মতোন। ওইদিকটা মনে হয় আমরা অতটা ভাবি নাই। এখন আমাদের এইদিকটা ভাবার প্রয়োজন আছে এবং বিকল্প চলচ্চিত্রের জন্য একটা নতুন অ্যাসথেটিকসের প্রয়োজন আছে।

ফৌজিয়া: আপনি তো প্রামাণ্যচিত্র পড়ান, নির্মাণ করেন। এমন কি কোনো ব্যাপার আছে যে ফিকশন না- প্রামাণ্যচিত্রেই আপনি নিজেকে প্রকাশ করতে চান?
মানজারেহাসীন: এরকম দিব্যি দিয়ে কাজটা শুরু করিনি। শুরুর দিকে কিন্তু মনে হয়েছে যে কোনো না কোনো সময়ে আমি কাহিনীচিত্র করব। আগে ডকুমেন্টারি দেখার কোনো সুযোগ হয় নাই। চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের মধ্যে দিয়েও প্রামাণ্যচিত্র দেখার সুযোগ হয়নি। এই ব্যাপারটা কিন্তু রয়েই গেছে এখোনো। একটা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্র অধ্যয়ন হলে আমরা দেশ-বিদেশের নানা ধরনের চলচ্চিত্রের ধারণা পাই, প্রামাণ্যচিত্র সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া সম্ভব ছিল। কথার কথা, বাংলাদেশে যদি একটা পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র শিক্ষার প্রতিষ্ঠান থকত তাহলে হয়তো ওই চলচ্চিত্র সম্পর্কে ধারণা তৈরি হতো। এটা তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ যারা চলচ্চিত্র নিয়ে চর্চা মানে যেকোনো ধরনের চর্চা করতে চায়- কেবলমাত্র নির্মাণ না। চলচ্চিত্র মাধ্যম নিয়ে কেবলমাত্র তাত্তি¡ক চর্চা করতে চায় তাহলে তার জন্যেও নানান ধরনের চলচ্চিত্রকে জানা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেটি আমাদের এখানে অনুপস্থিত। আমাদের যে স্কুলিং প্রসেস সেটা মূলত চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন। চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনেও কিন্তু আমি বলব যারা নীতি নির্ধারক ছিলেন- চলচ্চিত্র আন্দোলন যারা শুরু করেছিলেন বা বিভিন্ন চলচ্চিত্র সংসদে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন- খামতি বলাটা ঠিক কিনা- টু স্ট্রং টু ওয়ার্ড (ঞড়ড় ংঃৎড়হম ঃড় ড়িৎফ) – কিন্তু কথাটা ঠিক এই রকমই যে তাদের ঠিক এই ধারণাটা ছিল না যে সামগ্রিক অর্থে চলচ্চিত্রকে বোঝার প্রয়োজন আছে। আমাদের দেশের চলচ্চিত্র সংসদগুলোর যদি স্ক্রিনিং শিডিউল দেখি, লিস্ট দেখি তাহলে দেখব প্রথাগত পূর্ণদৈর্ঘ্যরে কাহিনীচিত্র শতকরা পঁচানব্বই ভাগ জায়গা দখল করে আছে। চলচ্চিত্রের অন্যান্য শাখা- নিরীক্ষাধর্মী চলচ্চিত্র, প্রামাণ্যচিত্র- একই রকম গুরুত্ব দিয়ে তারাও কিন্তু দেখান নাই। অথচ আমরা ধরে নেই চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের যে স্ক্রিনিং এর মধ্যদিয়েই সামগ্রিক চলচ্চিত্রের যে অগ্রযাত্রা, নানা ধরনের চলচ্চিত্র- দেশ-বিদেশের চলচ্চিত্রের ধারণাটা আমাদের এখানে পাওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের স্ক্রিনিংয়েও কাহিনীচিত্রের প্রাধান্য- চলচ্চিত্রের অন্যান্য শাখা অনুপস্থিত। তার অর্থ হচ্ছে চলচ্চিত্র মাধ্যমটা সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণাটিরই একটা দুর্বলতা আছে। আমাদের এখানে চলচ্চিত্রকে দেখা হয়েছে জনবিনোদনের অথবা প্রচারধর্মীতার উপকরণ হিসেবে। তারফলে আমাদের দেশে চলচ্চিত্র বলতেই আমরা বুঝেছি- সেটা নীতি নির্ধারক, সরকার, দর্শক, সমাজের মানুষ- ধরেই নিয়েছেন চলচ্চিত্র মূলত বিনোদনের মাধ্যম এবং সেটা কাহিনীর মধ্য দিয়েই স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে প্রকাশিত হতে পারে।
এই ভাবনাটা আমাদের দেশের স্বাধীনতার পর পরিবর্তন হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। এই যে স্টপ জেনোসাইড- স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমরা অনুভব করেছিলাম ওই সময়ের বাস্তবতাকে দেশের মানুষ এবং বিদেশের মানুষের কাছে তুলে ধরা দরকার; তার জন্য চলচ্চিত্র মাধ্যম হচ্ছে খুবই শক্তিশালী একটা মাধ্যম। এই ধারণাটা কিন্তু আমাদের হয়েছিল এবং নীতি নির্ধারকরাও কিন্তু অনুভব করেছিলেন। কিন্তু সেই ভাবনাটি আর বজায় থাকেনি। পরবর্তীকালের সরকারগুলো কখোনোই বিষয়টিকে সেইভাবে গুরুত্ব দেয় নাই। স্বাধীনতা যুদ্ধের কিছুদিন পর ওর আবেদন কমতে শুরু করে। ওই স্টাইল অব ফিল্মের আবেদন কমেনি, আমাদের দেশে যারাই চলচ্চিত্র বানাতে গেছেন তারা এই মাধ্যমে মানে প্রামাণ্যচিত্র বানাবার কথা ভেবেছেন তাদের কিন্তু সবসময় ভাবতে হয়েছে এর প্রদর্শন ব্যবস্থাটা কি হবে। বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র আন্দোলন আসার আগে পর্যন্ত এটা ছিল। আরেকটা ব্যাপার, প্রামাণ্যচিত্রের কোনো ঐতিহ্য ছিল না আমাদের। আমাদের চলচ্চিত্র সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হতে পারে প্রামাণ্যচিত্র- এই ধারণাটিই আমরা পাই নাই। তারফলে যে চলচ্চিত্র বানাতে আগ্রহী সে প্রথমেই কিন্তু ধরে নেয় যে কাহিনীচিত্রই বানাবো; কারণ ওটাই তার কাছে সবচাইতে পরিচিত ফিল্মিক এক্সপেশন। ফলে আমি যে কাহিনীচিত্র না বানাবার দিব্যি দিয়েছিলাম- এরকম না।
বিদেশে কিছুদিন আমি প্রামাণ্যচিত্র বিষয়ে পড়াশোনা করি। তখন সুযোগ হয়েছিল প্রামাণ্যচিত্রের কিছু ওয়ার্ল্ড ক্লাসিকস দেখার। ওটা আমাকে খুব আন্দোলিত করেছিল যে আচ্ছা এরকমও চলচ্চিত্র হতে পারে! যেসব দেশে ওগুলো তৈরি হয়েছে- সেখানকার সামাজিক-রাজনৈতিক ভূমিকা যখন জানতে পেরেছি তখন সেটা আমাকে খুব আকর্ষণ করেছে। পরে আমি যখন নির্মাণের মধ্যে গেছি দেখেছি যে- প্রামাণ্যচিত্রের মধ্যদিয়ে সরাসরি বাস্তব জীবন, বাস্তব মানুষের সাথে একটা দেয়া-নেয়ার সম্পর্ক তৈরি হয়। এতে নির্মাতা হিসাবে খুব তৃপ্ত হই, আমাকে আন্দোলিত করে। আমার এখনো মনে হয়, নির্মাতা হিসাবে আমার জন্য সবচেয়ে ভালো সময় হচ্ছে যখন আমি শ্যুটিং করি। এইটিই আমার জন্য সবচাইতে ভালো সময়। ওখানে আমি কতটা শ্যুট করতে পারলাম তারচাইতে ক্যামেরার মধ্য দিয়ে আরেক বাস্তবতা, আরেক অভিজ্ঞতার সাথে আমি নেগোশিয়েট করতে পারি- এই নেগোশিয়েশন প্রসেসটা বরাবরই আমার কাছে এক্সাইটিং মনে হয়েছে। সেই কারণে প্রামাণ্যচিত্রের মধ্যদিয়ে আমি চলচ্চিত্র নির্মাণটাকে যতটা উপভোগ করি বা আনন্দ পাই সেটি চলচ্চিত্রের অন্য কোনো কাজের মধ্য দিয়ে ততটা পাই নাÑ নির্মাণের অন্যান্য কাজের কথা বলছি।
আরেকটা দিক কী, প্রামাণ্যচিত্র নিয়ে আমি অনেককিছু ভাবতে পারি। ইন্সট্যান্টলি। আমার কাছে প্রামাণ্যচিত্রের বিষয়ের অভাব হয় না। হতে পারে এটা আমার মানসিক গঠনের কারণে। তাছাড়া রাজনীতি আমার জীবনের একটা বড় অংশ- যদিও সক্রিয় রাজনীতি ছেড়েছি অনেকদিন আগে। রাজনৈতিক প্রসঙ্গ আমাকে অনেক বেশি আকৃষ্ট করে। আমার সবসময় মনে হয়েছে প্রামাণ্যচিত্র যত সরাসরি রাজনৈতিক বা সামাজিক ভাবনাকে অ্যাড্রেস করতে পারে চলচ্চিত্রের পর্দায়- প্রথাগত কাহিনীচিত্র ওটা ওভাবে পারে না। পারলেও অনেক ঘুরিয়ে, অনেক ইনডাইরেক্ট প্রসেসের মধ্যদিয়ে এটা দেখায়। যদিও সরাসরি রাজনৈতিক ভাবনার কাহিনীচিত্র আছে। একটা পর্যায় পর্যন্ত আমি ওটা ভেবেছি।
তবে আমি যে ধরনের আয়োজন করতে পেরেছি আমার নিজের চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে সেখানে প্রথাগত কাহিনীচিত্র নির্মাণ করবার মতোন আয়োজন- মানে বাজেট আমি সংগ্রহ করতে সমর্থ হইনি। যেভাবে যতটুকু অর্থ আমি সংগ্রহ করতে পেরেছি- বেশির ভাগই এসেছে একধরনের প্রেসক্রাইভড প্রডাকশনের মাধ্যমে, কমিশনড প্রডাকশনের মাধ্যমে; সেখানে মূলত প্রামাণ্যচিত্র কমিশনের কাজ আমি পেয়েছি। সুতরাং একটা সময় প্রামাণ্যচিত্রই প্রধানত আমার কাজের ধারা হয়ে গেছে। গত ছয় সাত বছর আগেও আমি ভেবেছি কাহিনীচিত্র বানাবো- দু’একটি ছোটো চিত্রনাট্যের প্রাথমিক খসড়াও করেছি কাহিনী চলচ্চিত্রের জন্য। কিন্তু কেবলমাত্র বানানোর জন্যেই একটা শর্ট ফিচার ফিল্ম বানানোর অর্থ এখন আমি আর খুঁজে পাই না। সুতরাং একটা সময়ে আমার মনে হয়েছে যে না, আমি যে ধারাটি নিয়ে কাজ করছি- এই ধারাটি নিয়ে আমার এখনো অনেককিছু করার আছে। বাংলাদেশে এই ধারাটি যদি প্রতিষ্ঠা পায়- এবং এই ধারাতে কাজ করার জন্য যদি আমি আরো নতুনদের আগ্রহী করে তুলতে পারি তাহলে আমাদের দেশে সামগ্রিক চলচ্চিত্র নির্মাণে যে ধারাটি অবহেলিত ছিল সেটি প্রতিষ্ঠা পেতে পারে। আমি মনে করি যে, এটিও কম গুরুত্বপূর্ণ কাজ না। কিন্তু এখানে প্রধান যে বিষয়টি আমার মাথায় ছিল যে কাহিনীচিত্রই হোক বা প্রামাণ্যচিত্রই হোক- চলচ্চিত্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র হতে হবে। এর বিষয় ভাবনা, এর প্রকাশভঙ্গী, এর কারিগরি উৎকর্ষ শিল্পসম্মত হতে হবে। আমার মনে হয় যে আমাদের এই ব্যাপারটি খুব কম চলচ্চিত্রই উৎরাতে পেরেছে- আমিও এর থেকে বাদ যাই না। এখন আমার যে বয়স, আমার যে সম্ভাবনা, চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য যে আয়োজনটা আমি নিজের থেকে করতে পারি; নিজের থেকে করতে পারি এই কারণে যে ঠিক আমাদের মতোন চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা নেই বা প্রযোজকও নেই। আর প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের জন্য তো আরও নেই। সুতরাং আমাদের নিজেদের আয়োজনের মধ্যে যদি স্বাধীনভাবে কাজ করতে হয় তাহলে আমি বরঞ্চ নিজের যতটুকু শক্তি আছে সেটা প্রামাণ্যচিত্রের ধারাটা বেগবান করার জন্যই কাজ করব।
আমাদের এখানে চলচ্চিত্র মাধ্যমটা সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণারই একটা দুর্বলতা আছে। আমাদের দেশে চলচ্চিত্র বলতেই আমরা বুঝেছি- সেটা নীতি নির্ধারক, সরকার, দর্শক, সমাজের মানুষ- ধরেই নিয়েছেন চলচ্চিত্র মূলত জনরুচির চলচ্চিত্র হতে হবে এবং সেটা কাহিনীর মধ্য দিয়েই সবচাইতে স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে প্রকাশিত হতে পারে। এই ভাবনাটা স্বাধীনতার সময় স্টপ জেনোসাইড নির্মাণের মধ্যদিয়ে পরিবর্তন হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমরা অনুভব করেছিলাম ওই সময়ের বাস্তবতাকে দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে তুলে ধরা দরকার। তার জন্য চলচ্চিত্র মাধ্যম খুবই শক্তিশালী একটা মাধ্যম। এই ধারণাটা কিন্তু তখন আমাদের হয়েছিল এবং নীতি নির্ধারকরাও কিন্তু কিছুটা অনুভব করেছিলেন। কিন্তু সেইটি আর ট্রান্সলেটেড হয়নি। সরকার বা পরবর্তীকালের সরকারগুলো কখোনোই বিষয়টাকে সেইভাবে গুরুত্ব দেয় নাই। আর প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা হয় যেখানে সেখানেও প্রামাণ্যচিত্র গুরুত্বপূর্ণ একটা ফিল্মিক এক্সপ্রেশন- এটি বিবেচনা করা হয়নি সেইজন্য প্রামাণ্যচিত্রের ব্যাপারটি আর সামনে আসেনি। স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে ওই স্টাইল অব ফিল্মের আবেদন কমেনি কিন্তু আমাদের দেশে যারাই চলচ্চিত্র বানাতে গেছেন তারা এই মাধ্যমে কাজ করতে আর উৎসাহ বোধ করেননি।

ফৌজিয়া: আমরা এবার ডিজিটাল ফরম্যাট প্রসঙ্গে আসি। চলচ্চিত্র সাংঘাতিকভাবে প্রযুক্তি-নির্ভর একটা শিল্পমাধ্যম। ১৮৮৬ সালে যে প্রযুক্তি নিয়ে চলচ্চিত্র যাত্রা শুরু করেছিল আজ ১২৮ বছর পর আর সে সেখানে দাঁড়িয়ে নেই। এর ভালো-মন্দ, পক্ষ-বিপক্ষে নানান মতামত আছে। শিল্প হিসেবে নিজেকে প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির নিত্য-নতুন আবিষ্কার চলচ্চিত্র নানান ফর্মে অ্যাডপ্ট করে নিচ্ছে। বিশেষ করে ডিজিটাল ফরম্যাটের কারণে ফিল্মের এক্সপ্রেশনে নানান পরিবর্তন এসেছে। আপনার অভিমত কি?
মানজারেহাসীন: আসলে আমার মনে হয় যে ডিজিটাল টেকনোলজি- ডিজিটাল ফরম্যাট না শুধু, ডিজিটাল টেকনোলজি নানাক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। তার একটা দিক হচ্ছে চলচ্চিত্র বা অডিও ভিজুয়াল। অডিও ভিজ্যুয়াল রেকর্ডিং এবং রিপ্রডাকশন- টেকনোলজি নির্ভর; এই টেকনোলজি যত পরির্বতন হবে- কম হোক বেশি হোক আমাদের নির্মাণ প্রদর্শন প্রক্রিয়ায়ও তার প্রভাব থাকবে। এখন কোনো কোনো দেশে- এই নতুন টেকনোলজি অ্যাডাপটেশনের ব্যাপারটা সহজ, কোনো কোনো দেশে এটা কঠিন। কোনো দেশের সার্বিক সামাজিক-অর্থনৈতিক-টেকনোলজিক্যাল অ্যাডভান্সমেন্টের উপর আসলে ব্যাপারটা নির্ভর করে। এটা আপনার আমার একার ব্যাপার নয়। আরেকটি হচ্ছে বিশেষ উদ্দেশ্যে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা। আমার মনে হয় যে আমাদের দেশে এই দুটো বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ। নানা উন্নত, হাল আমলের প্রযুক্তি আমরা ব্যবহার করছি- আমাদের ব্যক্তি জীবনে, আমাদের সামাজিক জীবনে এবং আমাদের দেশের অন্যান্য কর্মকাÐে। কিন্তু সবটাই আবার আমরা দৃশ্যশ্রাব্য মাধ্যমে ব্যবহার করছি বা ব্যবহার করতে পারছি এমন না। আমি মনে করি এটা এখনো ম্যাটার অফ চয়েজ- আমাদের দেশে, পৃথিবীর নানা দেশে। ট্র্যাডিশনালি আমাদের দৃশ্য-শব্দ ধারণ ও পুনঃউৎপাদন প্রক্রিয়া- ট্র্যাডিশনাল বলতে আমি বুঝি যে অ্যানালগ কিংবা ফিল্ম বেজড যে টেকনোলজি ছিল; সেখানে আমরা কোনো জায়গায় অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছি বা আদৌ হচ্ছি কিনা। অ্যানালগ বা ফিল্মের ক্ষেত্রে অসুবিধা যদি বলি যে ষাটের দশকের পর থেকে এর আর কোনো কারিগরি উৎকর্ষ ঘটেনি- বিশ্বজুড়ে। তারফলে যে টেকনোলজি ছিল তা দিয়ে যা করা যায় সেটা মোটামুটি আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের দেখা আছে। তার অনেকটাই আমরা করতে পারি নাই। কারণ সেই টেকনোলজি ব্যবহারে আমরা অভ্যস্থ নই। সেই ধরনের বিনিয়োগ করাও সম্ভব না এবং সেই এক্সপার্টিজও নাই। আরেকটা বিষয় হচ্ছে চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রদর্শনের প্রযুক্তি আবিষ্কারে আমাদের নিজেদের কোনো কন্ট্রিবিউশন নাই- বাইরের দেশে যা তৈরি হয় সেটা আমরা ভোক্তা হিসাবে ব্যবহার করি। সবমিলিয়ে এর উপরে আমাদের কোনো কন্ট্রোল নাই। ১৬ মি.মি. ফিল্ম আপনি চাইলেও এখন আর পাবেন না। এটা তো আমরা বলি নাই যে এটা আমরা ব্যবহার করব না। অথচ আমাদের দেশে আমরা একটা আন্দোলনই শুরু করেছিলাম যার প্রধান ফরম্যাটটা ছিল ১৬ মি.মি.। কিন্তু এখন আপনি সেটা চাইলে পাবেন না। কারণ যারা উৎপাদন করছে তারা মনে করছে এটা আর লাভজনক ব্যবসা না। এই রকম একটা সিচুয়েশনে কিন্তু আমাদের মতন দেশগুলোর ক্ষেত্রে হচ্ছে কি যে এই প্রযুক্তিগুলো উৎপাদকরা যেহেতু ওই টেকনোলজিগুলো আর উৎপাদন করতে রাজি না- সুতরাং এখানে আমরা একধরনের ভিকটিম হিসেবে থাকি। তার ফলে দেখা যাচ্ছে যে, ফিল্মের ক্ষেত্রে দামে কম ফরম্যাটটা আর না পাওয়া যাচ্ছে না। আপনাকে বাধ্য হয়ে হায়ার ফরম্যাটের দিকে যেতে হচ্ছে। সেটা ব্যবহারের জন্য আপনার সেই অর্থনৈতিক শক্তি লাগবে। তা নাহলে আপনাকে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হবে। হাত গুটিয়ে তো আমরা কেউই বসে থাকতে চাই না। সুতরাং আমাদের বিকল্প কিছু খুঁজতে হবে। সেই অলটারনেটিভের একটা হচ্ছে ভিডিও ফরম্যাট। প্রথমদিকে ভিডিও ফরম্যাটটা সস্তা ছিল, ইউজার ফ্রেন্ডলি ছিল, ভিডিও ফরম্যাটটা কম দামে সহজে পাওয়া যাচ্ছিল। সুতরাং আমরা সেটার দিকে গেছি। কিন্তু অ্যানালগ ভিডিও ফরম্যাটে একটা সমস্যা ছিল- আন্তর্জাতিকভাবে মানসম্পন্ন জায়গায় এর কোয়ালিটি নিয়ে যেতে পারে নাই। কিন্তু তারপরও ভিডিও ফরম্যাটের ব্যবহার দেশে-বিদেশে বাড়তে শুরু করে। টেলিভিশন তো অনেক আগেই ভিডিও ফরম্যাট নিয়েছে। টেলিভিশনের বাইরেও আমরা ভিডিও ফরম্যাট ব্যবহার করতে শুরু করি। মূলত ইউজার ফ্রেন্ডলি এবং কস্ট ইফেকটিভ বলেই কিন্তু ব্যবহারটা বেড়েছিল। কিন্তু ডিজিটাল টেকনোলজি আসার পরে ট্র্যাডিশনাল অডিও-ভিজ্যুয়াল ধারণ এবং রিপ্রডাকশনের যে মান সেটা আস্তে আস্তে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে। এখন তো বলাই হচ্ছে ৩৫ মি.মি. এবং ডিজিটাল ফরম্যাটের পার্থক্য খুব সামান্য- এটা একটা ব্যাপার। দ্বিতীয় হচ্ছে, এই মাধ্যমটা নতুন কিছু সম্ভাবনা তৈরি করছে। সবচেয়ে লোয়ার ফরম্যাটেও অডিও-ভিডিওর যে রিপ্রডাকশন করতে পারে- সেটি আগের কোনো ফরম্যাট করতে পারত না। এই টেকনোলজি অনেক ইউজার ফ্রেন্ডলি, এই টেকনোলজি দামে সস্তা, সহজে কিনতে পাওয়া যায়। তৃতীয়ত, এটা এমন একটা টেকনোলজি যেহেতু এটা ইনফরমেশন নিয়ে কাজ করে মূলত, ইনফরমেশনকেই নানাভাবে ম্যানিপুলেট করতে পারে- তারফলে যেকোনো রেকর্ডেড ভিজ্যুয়াল এবং সাউন্ডকে আপনি ক্রিয়েটিভলি অনেক অন্যভাবে ম্যানিপুলেট করতে পারেন। অর্থাৎ আপনার এক্সপ্রেশনের হরাইজনটাকে অনেক বড় করে দিচ্ছে। একদম নির্মাণের জায়গা থেকে বলছি- এতগুলো সুবিধা নিয়ে আসছে এই ডিজিটাল টেকনোলজি। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে প্রদর্শনী। সেক্ষেত্রেও আমরা দেখছি যে নানা ধরনের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। আগে যেটা সিনেমা হলভিত্তিক ছিল সেটা এখন আর সিনেমা হলভিত্তিক না। তারপর সিনেমা হল এবং টেলিভিশনকেন্দ্রিক ছিল। এখন সেটা টেলিভিশন ছাড়িয়ে একদম ছোট স্ক্রিনেও চলে আসছে। ঘরে স্ক্রিনের মধ্যে চলে আসছে, কম্পিউটারে চলে আসছে, ইন্টারনেটে চলে আসছে। সুতরাং ভিউয়িং এবং ডিস্ট্রিবিউশনের ক্ষেত্রেও কিন্তু একটা বড় পরিবর্তন হয়ে গেছে। এই বিষয়গুলোকে যদি আমরা চলচ্চিত্র নির্মাণের জায়গা থেকে দেখি তাহলে এটাকে দুভাবে দেখা যেতে পারে। একটা হলো, এমন চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্ভব যেটা ফিল্ম ফরম্যাটে সম্ভব না। যেমন ধরেন কম্পিউটার বেজড ভার্চুয়াল রিয়ালিটি- যেটা মূলত সায়েন্স ফিকশন বা অন্যান্য ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছে। সুতরাং আমরা নতুন ধরনের ভিজ্যুয়াল তৈরি করতে পারছি। ফিল্মে আগে যেটা ছিল যে ইমেজের বিশ্বাসযোগ্যতা। এখন কিন্তু আপনি এই ইমেজের বিশ্বাসযোগ্যতাকে আইদার বাড়িয়ে দিতে পারেন অর্থাৎ হাইপার রিয়ালিজমের দিকেও যাওয়া যায় আবার এটা একটা অবিশ্বাসযোগ্য রিয়ালিজমও তৈরি করে। যাকে আমরা বলছি ভারচুয়াল রিয়েলিটি। এই দুটি বিষয়কে যদি সদর্থে ব্যবহার করেন তাহলে দেখা যাবে যে যে নতুন ধরনের সিনেমা বা নতুন ধরনের অডিও ভিজ্যুয়াল নির্মাণের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আবার যদি এই ফরম্যাটের লোয়ার এন্ডে আসি তবে দেখা যাবে নির্মাতার কন্ট্রোল অনেক বেশি থাকার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
লো-এন্ড ডিজিটাল টেকনোলজির ক্ষেত্রে মোটামুটি স্বল্প বিনিয়োগে এমন টেকনোলজি আমরা পাচ্ছি যে টেকনোলজি গ্রহণযোগ্য অডিও-ভিজ্যুয়াল রেকর্ডিং এবং রিপ্রডাকশনের সুযোগটা দিচ্ছে। তারফলে কিন্তু অনেক বেশি মানুষ এই টেকনোলজি ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে। একেবারে যদি তাত্তি¡ক ভাষায় বলি তাহলে বলব যে এক ধরনের গণতন্ত্রায়ন অব রেকর্ডিং এন্ড ডিসিমিনেশন অব অডিও- ভিজ্যুয়াল-এর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এটার ভালো দিক হচ্ছে অনেক মানুষ এই কর্মযজ্ঞে পার্টিসিপেট করতে পারছে। অনেক মানুষ সেল্ফ এক্সপেশনের জন্য বা নিজেদের প্রয়োজনে অডিও-ভিজ্যুয়ালকে ব্যবহার করতে পারছে; ট্র্যাডিশনাল ফিল্ম প্রডাকশনে এই সুযোগটা ছিল না। টেকনোলজিক্যাল জটিলতার কারণে এবং হিউজ ইনভেস্টমেন্টের কারণেও বেশি মানুষ অডিও-ভিজ্যুয়াল প্রডাকশনে অংশ নিতে পারে নাই। ডেমোক্রেটাজাইশেনটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। সেটাকে যদি অন্যভাবে ব্যবহার করা যায় যেমন রাজনৈতিক সংগ্রামে, ধরা যাক কোনো একটা ইমপর্টেন্ট ইভেন্টকে ডকুমেন্ট করার ক্ষেত্রে, ইভেন একবারে ব্যক্তিগত জীবনকে তুলে দরার ক্ষেত্রে- যেটা আগে সম্ভব ছিল না। একটা ৩৫ মি.মি. ক্যামেরা দিয়ে আপনি আপনার জীবনের দিনলিপি ভিজ্যুয়ালাইজ করতে পারবেন না। সম্ভব না- কিন্তু এখন ডিজিটাল ক্যামেরায় এটা সম্ভব। সুতরাং একধরনের ইমেজ প্রডাকশনের, ডিসিমিনেশনের গণতন্ত্রায়ন ঘটেছে। অনেক বেশি মানুষ এই মাধ্যমে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে। তারফলে আমরা নতুন ধরনের এক্সপেরিয়েন্স, নতুন ধরনের ইমেজ, নতুন ধরনের ভাবনাকে পর্দায় দেখার সুযোগ পাচ্ছি। অনেক মানুষ এই মাধ্যমটাকে সেল্ফ এক্সপ্রেশনের জন্য ব্যবহার করছে। তাদের দৈনন্দিন জীবনের ঘটনাকে ধারণ করতে পারছে। সেটা ছোট বা বড় পরিসরে শেয়ার করতে পারছে। অনেক ইমপর্টেন্ট ইভেন্টকে ধারণ করতে পারছে যেটা হয়ত আগে সম্ভব ছিল না। এটা হচ্ছে একদিকে। আরেকদিকে, এই যে অনেক মানুষের পার্টিসিপেশন এর যে নেগেটিভ দিক তারমধ্যে অনেকবেশি অডিও-ভিজ্যুয়াল আবর্জনা তৈরি হচ্ছে- যেটা হওয়ার কোনো দরকার ছিল না। আমাদের দেশে এখন প্রচুর মানুষের হাতে মোবাইল ফোন আছে- ওটা দিয়ে ছবি তুলতে পারে। এটা তাদের আনন্দের জন্য হয়তো ইমপরট্যান্ট। কিন্তু তার সবকিছুকে তো আর আমরা ছবি হিসাবে বা শিল্প হিসেবে মূল্য দিতে পারব না। তার কাছে হয়তো এর মূল্য আছে, একটা হিসেবে হয়তো এর গুরুত্ব আছে কিন্তু শিল্প হিসেবে বা একটা গুরুত্বপূর্ণ স্টিল ফটো হিসেবে হয়তো তার মূল্য নেই। অনেক বেশি
অডিও-ভিজ্যুয়াল হলেই সেটা খুব ভালো কিছু হবে- তা না। কিন্তু আস্তে আস্তে এটা করার মধ্য দিয়ে উৎকর্ষের দিক পৌঁছানোর সুযোগ একজন সাধারণ মানুষের পক্ষেও সম্ভব। সাধারণ মানুষ বলতে আমি বলছি- যার হয়তো তেমন আয়োজন নাই, টেকনোলজির সেই একসেস নাই- সেও কিন্তু এটাতে পার্টিসিপেট করতে পারছে। কিন্তু এখানে সমস্যা ওটা- অনেক ট্র্যাস তৈরি হবে। সেটা থেকে আবার ঝাড়াই-বাছাইয়ের প্রশ্নটা থাকবে আর কী। অনেক রেকর্ড হলেই যে ভালো অডিও-ভিজ্যুয়াল এক্সপেশনের জায়গা তৈরি হয়েছে সেটা বলা যাবে না। তবে এতে সমগ্র সিনেমার চরিত্রটাকেই পাল্টে দেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ সিনেমা অনেক বেশি করে নতুন সিনেমার দিকে যাচ্ছে। দ্বিতীয় আরেকটা পজিটিভ দিক হচ্ছে এই সিনেমার উপর যে ট্র্যাডিশনাল যে পুঁজির নিয়ন্ত্রণ এটা কিন্তু ইফেটিক্টভলি ভাঙার একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এটা ইনডিভিজ্যুয়াল মানুষই পারবে- ইনডিভিজ্যুয়াল একজন ফিল্মমেকারই পারবেন। আপনার যদি কম্পিউটার এক্সেস থাকে, ইন্টারনেট এক্সেস থাকে- এটার জন্য তো ইনভেস্টমেন্ট তেমন বড় না; তারফলে আপনি ছবি বানিয়ে ডিস্ট্রিবিউটরের জন্য অপেক্ষা করবেন যেটা এখন প্রচলিত আছে- সেটা আপনাকে নাও করতে হতে পারে। আপনি ইন্টারনেটে আপনার ছবি দেখাতে পারেন। আপনি হয়তো বড় আকারে দেখাতে পারছেন না, কিন্তু পারছেন তো। আপনি ডিভিডি আকারে ছবি রিলিজ করতে পারেন। সুতরাং এখানে নির্মাতার বা ক্রিয়েটিভ আর্টিস্টের নিয়ন্ত্রণের সুযোগ তৈরি হয়েছে। আরেকটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। যারা ঠিক মুভিং ইমেজ নিয়ে কাজ করে না তারা কিন্তু তাদের কাজের মধ্যে মুভিং ইমেজ ব্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছে। ইন্টারনেটে নিউজ- সেখানে কিন্তু তারা মুভিং ইমেজ ব্যবহার করছে। যেকোনো ডেমোস্ট্রেটিভ ভিডিওতে তারা মুভিং ইমেজ ব্যবহার করছেন। ইন্সস্টলেশন এবং অন্য শিল্পমাধ্যমের ক্ষেত্রেও মুভিং ইমেজ ব্যবহার হচ্ছে। সুতরাং মুভিং ইমেজের এবং অডিও-ভিজ্যুয়াল ইমেজের হরাইজনটা অনেক বেড়ে গেছে। এর নানান দিক আছে- কোনটা ভালো সেটা এখনই বলা মুশকিল। কিন্তু অনেক নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

ফৌজিয়া: প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে ডিজিটাল ফরম্যাট যেন আশীর্বাদ হয়ে এসেছে…
মানজারেহাসীন: হা সেটা বলতেই হয়। আমাদের ডকুমেন্টরি প্রডাকশনে বাজেটের একটা বড় অংশ যায় র ম্যাটেরিয়াল কিনতে। আমরা শুটিং রেসিও-এর কথা বলি। যখন ভিডিও আসল- তখন টেপের মূল্য যত কমে এসেছে, তাতে আপনি যে পরিমাণ ইমেজ ধারণ করতে পারবেন সেটা তো ১৬ মি.মি. কিংবা ৩৫ মি.মিটারে বাজেটে করতে পারবেন না। সুতরাং প্রামাণ্যচিত্রের ক্ষেত্রে ডিজিটাল টেকনোলজি একটা বড় অ্যাডভানটেজ নিয়ে এসেছে। ক্যামেরা ছোট, লাইট সেন্সেটিভ ক্যামেরাগুলো আসছে। এটা ডকুমেন্টারি বা অন্য ধরনের প্রডাকশনের ক্ষেত্রে, ইভেন অন্য ধরনের ফিকশনাল বা এক্সপিমেন্টাল প্রডাকশনের ক্ষেত্রেও নতুন সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে আমাদের। কথার কথা, উইদাউট ক্যামেরা সিনেমা বানানোর যে সুযোগ-কম্পিউটার জেনারেটেড ইমেজ দিয়ে- তার উদাহরণও কিন্তু আমাদের সামনে আছে। আজকে আপনি চাইলে ৩৬৫ দিনের অডিও-ভিজ্যুয়াল দিনলিপি তৈরি করতে পারেন। আনএক্সপোজড এরিয়া অফ লাইফ- টেকনোলজির কারণে যা এক্সপ্রেসড হয় নাই, হতে পারে নাই অডিও-ভিজ্যুয়াল মাধ্যমে- সেটা কিন্তু ডিজিটাল টেকনোলজির সুযোগ নিয়ে করা যাচ্ছে। এখন এই যে রাশান অব আর্ক-র মতোন ছবি- যেটা এক শটের সিনেমা; এটা ট্র্যাডিশনাল টেকনোলজিতে সম্ভবই ছিল না। বা ওই যে রির্টান অব দ্য ক্লোন, স্টার ওয়ারস ২- এই ধরনের ছবি- বিগ বাজেটের কম্পিউটার জেনারেটেড ছবি- এই ধরনের ছবি কিন্তু আগে তৈরি করার কোনো স্কোপই ছিল না। আবার সেলিব্রেশন (পরিচালনা: ————, দেশ:———-) এর মতোন একেবারে লো এন্ড টেকনোলজি দিয়ে বিশ্ব কাঁপানো ফিকশন ফিল্মও তৈরি করার কথা কিন্তু ভাবা যেত না। সুতরাং আমার বলার কথা এই যে ডিজিটাল টেকনোলজিতে নিউ হরাইজন তৈরি করার সুযোগ হয়েছে।
আমাদের দেশে ব্যক্তি মানুষ হিসেবে আপনি এই অ্যাডভানটাজ কতটা নিতে চান- কেন নিতে চাইবেন সেটা যদি স্পষ্ট থাকে তবে কিন্তু অনেককিছু করতে পারেন। আর আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাগুলোকে আমরা যদি ক্রিয়েটিভলি ব্যবহার করতে পারি তাহলে নতুন ধরনের চলচ্চিত্র আরো বেশি করে তৈরি করা সম্ভব হবে যেখানে নির্মাতা আরো বেশি করে স্বাধীন হবেন। আমি কিছুদিন আগে এক ফিল্মমেকারের ইন্টারভিউ পড়ছিলাম- তিনি বলছিলেন, ডিজিটাল টেকনলজির কারণে ফিল্ম আবার আর্ট হিসেবে বিকশিত হবার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। কারণ এখন ওয়ান পারসন ক্যান ক্রিয়েট অ্যা ফিল্ম। আমরা যদি পেইন্টিংয়ের কথা চিন্তা করি- ওটা তো একজনের ক্রিয়েশন। আমরা এখন পর্যন্ত ফিল্মকে ধরে নিচ্ছি এটা কোলাবোরেটিভ আর্ট নির্মাণ প্রসেস। কোলাবোরেটিভ প্রসেসে ফিল্ম নির্মাণের সুবিধা অনেক আছে- আবার সমস্যাও আছে। কথার কথা, একজন পেইন্টার এককভাবে একটা শিল্প সৃষ্টি করে, আবার লেখক যখন এককভাবে একটা শিল্প সৃষ্টি করে, একজন ফটোগ্রাফার যখন এককভাবে একটা শিল্প সৃষ্টি করে, একজন গায়ক যখন এককভাবে শিল্প সৃষ্টি করে তখন সেই শিল্পও কিন্তু কম ইমপরটেন্ট না- কোলাবোরেটিভ শিল্প ফিল্মের পাশাপাশি। কিছুদিন আগে থাই এক ফিল্ম মেকারের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে। উনি একজন মঙ্ক, ব্যাঙ্ককের বাইরে থাকেন। উনি অন্য মঙ্কদের মতোন না, উনি সিনেমা বানান। তিনি ডকুমেন্টারি জাতীয় সিনেমা বানান মাঝে মাঝে। বেশ নাম করেছেন উনি। মাঝেখানে একবার ব্যাংকক গেছিলাম, উনার সাথে দেখা করলাম। উনি একটা শ্লোগান দেন- ওয়ান ক্যামেরা এন্ড ওয়ান কম্পিউটার ক্যান ক্রিয়েট অ্যা মুভমেন্ট অব নিউ ফিল্ম। উনি বলছেন, আমার কাছে যদি একটা ক্যামেরা থাকে আর কম্পিউটার থাকে তাহলে নতুন সিনেমা বানাবার আন্দোলন করতে পারি আমি। এটা কী- এটা তো ওয়ান ম্যান সিনেমাটোগ্রাফি, ওয়ানম্যান ফটোগ্রাফি, ওয়ানম্যান ফিল্ম মেকিং। এর মধ্যদিয়ে কোলাবোরেটিভ প্রসেসে ফিল্মমেকিংয়ের নেগেটিভ আসপেক্টকে কিন্তু খুব সহজে ডিসকার্ট করা যায়। ইনডিভিজ্যুয়াল- একজন ইনডিভিজ্যুয়াল মানুষ তার ইনডিভিজ্যুয়াল স্কিল দিয়ে একটা ফিল্ম তৈরি করতে পারবে। অন্যান্য ক্রিয়েটিভ আর্ট ফর্মের শিল্পীর মতোন এখন একজন ফিল্ম মেকার নিজের শিল্প সৃষ্টি করতে পারছেন। এই যে সেডে বেনিং- এই ইয়ং মেয়েটা যে ছবি বানিয়েছে- যাকে এখন বলা হচ্ছে ওয়ান অব দ্য মোস্ট ইম্পরটেন্ট ফিল্ম মেকার অব টুয়েটি ফার্স্ট সেঞ্চুরি। ওর একটা পিক্সেল ভিডিও ক্যামেরা ছিল, এখনকার মতোন ডিজিটাল ক্যামেরাও না- সেটা দিয়ে সে যে ঘরে থাকে সেই জীবনকে এক্সপোজ করেছে। ধারাবাহিকভাবে ছোট ছোট অনেকগুলো ছবি বানিয়েছে। সে এখন কনসিডারড ওয়ান অব দ্য ইম্পরটেন্ট ফিল্ম মেকার। সুতরাং এই যে সুযোগটা, সুবিধাটা তৈরি হয়েছে- এটা কিন্তু খুব ইম্পরট্যান্ট ব্যাপার। আবার আপনি চাইলে ফিল্মমেকিংয়ের কোলাবোরেটিভ প্রসেসের মধ্যেও এই টেকনোলজিকে ব্যবহার করতে পারেন। এই সুযোগটা কিন্তু আগে অ্যানালগ, ফিল্ম বেজড টেকনোলজিতে সম্ভব ছিল না। যেটা আগে বলছিলাম, রাশান আর্ক-র মতোন ওয়ান শট ফিল্ম- আসলে ওয়ান শট মানে তো শুধু ওয়ান শট না, ওয়ান শট মানে আসলে ওখানে ফিল্মের ল্যাঙ্গুয়েজটাকেই পাল্টে দেওয়া হয়েছে, ফিল্মের ন্যারেটিভটাকে পাল্টে দেওয়া হয়েছে। এই যে টাইমকোড বলে বিখ্যাত একটা ডিজিটাল ফিল্ম আছে যেখানে একই স্ক্রিনকে চারটা স্পিøল্ট করে চারটা ইমেজ ব্যবহার করেছেন পরিচালক। একই গল্পের চারটা ভারসন সাইমালটেনাসলি চলছে। মনে হতে পারে, এটা খুব ডিসটার্বিং হবে- কিন্তু দ্যায়ার আর পসিবিলিটিজ টু টেল ইয়োর স্টোরি ডিফারেন্টলি। স্পিøল্ট স্ক্রিন আমাদের কাছে নতুন কিছু না।
ইয়োনেস মেকাস বলে আমেরিকার বিখ্যাত এক্সপেরিমেন্টাল ডকুমেন্টারি মেকার কাম কিউরেটর আছেন। উনি ঘোষণা দিয়েছেন যে উনি প্রতিদিন একটা করে ছবি বানাবেন। উনার ওয়েব সাইটে গেলে দেখবেন একশ কয়টা ছবি যেন উনি পোস্ট করে দিয়েছেন। নানা লেংথের ছবি। এই যে নতুন ধরনের ফিল্মিক এক্সপ্রেশন তৈরি হয়েছে- এর যে সুযোগটা সৃষ্টি হয়েছে; এটা কিন্তু ডিজিটাল টেকনোলজির জন্যে হয়েছে।
ডকুমেন্টারির ক্ষেত্রে তো আরো বলব। এই যে ডিভিডি- ডিভিডির মধ্য দিয়ে আপনি যদি ডিসেমিনেশন প্রসেসটা ইফেটিভলি করতে পারেন, অনলাইন ডিসেমিনেশন যদি করতে পারেন তবে এটা কিন্তু আপনাকে ইকোনিমেক্যালি ভায়াবল অবস্থায়ও নিয়ে যেতে পারে। ট্র্যাডিশনাল সিনেমা হল বা টেলিভিশন যদি আপনার ছবি নাও নেয়- নানা কারণেই না নিতে পারে- রাজনৈতিক কারণে, এন্টারটেইনিইং না হওয়ার কারণে, স্পন্সর পাবে না- যেটা আমাদের সবসময় বলা হয়- সেটার কারণেও না নিতে পারে। ডিজিটাল টেকনোলজি কিন্তু ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউশনের হরাইজনটাকে বাড়িয়ে দিয়েছি। আরেকটা ব্যাপার। ফাইন আর্টেস-এ আগেও মুভিং ইমেজ ব্যবহার হতো। কিন্তু এখন আরো বেশি ব্যবহার হচ্ছে। এখন ইন্টার ডিসিপ্লিনারি ইন্টার‌্যাকশনের মধ্যদিয়ে নতুন একধরনের ফিল্মিক এক্সপ্রেশনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আমরা জানি যে সিনেমা অনেক বেশি করে অন্যান্য আর্ট থেকে ধার করেছে। সবচেয়ে বেশি ধার করেছে সম্ভবত পেইন্টিংস থেকে। এখন কিন্তু সিনেমার দেয়ার পালা। আমি বলব যে, এই টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চরি বা গত সেঞ্চুরির শেষের দিকে নতুন যে ফাইন আর্টস এখন যে হারে মুভিং ইমেজ এবং সাউন্ড ব্যবহার করছে- এতে সিনেমার আবার ওই মাধ্যমকে তার ঋণ শোধ করার পালা শুরু হয়েছে। এখন নিউ মিডিয়ামের আর্টিস্টরা সিনেমার প্রধান উপাদান মুভিং ইমেজকে যেভাবে ব্যবহার করছেন- তারা সিনেমার মতোন ব্যবহার করছেন না- তার কারণও নাই। তাদের প্রয়োজনটা ভিন্ন, মিডিয়ামটা ভিন্ন, এক্সপ্রেশনটা ভিন্ন। এতে মিডিয়ামগুলোর মধ্যে একটা দেয়া-নেয়ার ব্যাপার শুরু হয়েছে। এর মধ্যদিয়ে সিনেমা কিন্তু ফাইন আর্টসকে অনেক বেশি করে প্রভাবিত করতে চলেছে। এটা আমাদের দেশেও দেখতে পাচ্ছি। এর মধ্যদিয়ে আমি তো বলব সিনেমা আরো বড় হচ্ছে, আরো মহৎ হচ্ছে। ওটাকে সিনেমা বলব না। তবে আমরাও যখন মানে সিনেমা যখন ফাইন আর্টস থেকে নিয়েছে তখন হুবহু তো নেয়নি। সিনেমার মতোন করে সেখান থেকে আহরণ করেছে। সেটা ফ্রেমিং হোক, কালার হোক, কম্পোজিশন হোক- সিনেমার মতোন করে ব্যবহার করেছে। আমরা তো আর পেইন্টারদের মতোন করে ফ্রেমিংকে, কালারকে ব্যবহার করি নাই বা কম্পোজিশনকে ব্যবহার করি নাই। এটা কিন্তু একটা ইন্টারেস্টিং জায়গা। ডিজিটাল টেকনোলজির কারণে কিন্তু এটা খুব বড় আকারে করা সম্ভব হয়েছে। এখানে মাল্টি মিডিয়ামের দেয়া নেয়ার একটা সম্পর্ক তৈরির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ফৌজিয়া: ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের উদাহরণ হিসেবে আপনি যে ফিল্মগুলো নাম বললেন সেগুলো সব বাইরের ছবি। বাংলাদেশে এমন ডিজিটাল ফিল্মের নজির কিছু আছে কি?
মানজারেহাসীন: আমি বলব যে এই জায়গাটার ক্ষেত্রে আমাদের একটু চিন্তার দুর্বলতা আছে। খুব সাদামাটাভাবে যদি বলি, আমরা ডিজিটাল টেকনোলজিটা নিচ্ছি কেবলমাত্র আমরা গরিব ফিল্মমেকার- এই কারণে? ফিল্ম ফর্ম্যাটটা এক্সপেনসিভ বলে অ্যাফোর্ড করতে পারি না- এইভাবে দেখলে কিন্তু আমরা ডিজিটাল টেকনোলজির অ্যাডভানটেজকে খাটো করে দেখব। আমাদের দেশে ফিল্মমেকিংয়ের ক্ষেত্রে- সেটা ডকুমেন্টারি বা ফিকশন যা-ই হোক না কেন- ডিজিটাল টেকনোলজিকে বিবেচনা করা হচ্ছে যে এ-দিয়ে ফিল্ম-ফর্ম্যাটের কাছাকাছি কাজ করা যায়। সবার আকাক্সক্ষা কিন্তু সিনেমার মতোন এটি হয়ে উঠুক। এইখানে আমার মনে হয় যে একটু বোঝার ভুল আছে- মানে বোঝার একটু খামতি আছে। আমাদের বুঝতে হবে যে ডিজিটাল টেকনোলজি একটা নতুন টেকনোলজি। এই টেকনোলজি ফিল্ম ফর্ম্যাটের অনেককিছু করে দিতে পারে; কিন্তু ফিল্মের মতো করেই যদি ডিজিটাল টেকনোলজিকে ব্যবহার করতে চাই- তাহলে এটা নতুন কিছু তৈরি করতে পারবে না। এটা ফিল্মেরই দাসত্ব করতে থাকবে। ফিল্ম মানে আগের ওই অ্যানালগ টেকনোলজির দাসত্ব করতে থাকবে।
আমরা জানি যে আজকাল ছোট ডিজিটাল ক্যামেরা কত দুর্গম জায়গায় খুব সহজে নিয়ে যাওয়া যায় যেটা ৩৫ মিলিমিটার বা অন্য কোনো ফিল্ম ক্যামেরায় করা কঠিন। আমি যে শট টেকিংয়ের কথা বললাম, ফ্রেমিংয়ের কথা যদি বলি, মান্টিলেয়ারিং অব ইমেজের কথা হতে পারে- এগুলো এক্সপেরিন্টাল ফিল্ম মেকারও কিন্তু ফিল্ম ফর্ম্যাটে করতে পারেন না। তারপরে সাউন্ডে যে নানা ধরনের কারেকশন, ইমেজ ইজ নট সুপ্রিম- ইমেজকে আপনি নানাভাবে ম্যানিপুলেট করতে পারেন। এই জিনিসগুলো যদি মাথায় রাখেন তাহলে দেখবেন বাংলাদেশে যেটা হচ্ছে সেটা ফিল্ম ফর্ম্যাটের সাবস্টিটিউট হিসাবে ডিজিটাল ফর্ম্যাটকে ব্যবহার করা হচ্ছে। এইটাই বড়। ফিল্ম ফমরাটের সাবস্টিটিউট হিসেবে ভিডিও বা ডিজিটাল ফর্ম্যাটকে ব্যবহার করা হচ্ছে, ফাইন, এটাতে আমার আপত্তি নাই। এটা একটা দিক। কিন্তু এইখানে আটকে থাকলে ডিজিটাল টেকনোলজির পূর্ণাঙ্গ সুযোগটা আমাদের নেয়া সম্ভব হবে না। ডিজিটাল টেকনোলজি যে ইটসেল্ফ অডিও-ভিজ্যুয়াল প্রডাকশনে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে- সেইটি কিন্তু আমাদের দেশের ছবিতে তেমনভাবে দেখা যাচেছ না। কিছু ছোটখাট উদাহরণ আছে। যেমন ধরেন বলা যায়, ডকুমেণ্টারির ক্ষেত্রে ইয়াসমিন কবীরের কাজগুলো। ওয়ান পারসন সিনেমা মেকিংয়ের কাছাকাছি সে গেছে। রিসেন্ট ছবিতে অবশ্য পোস্ট প্রডাকশনে সে অন্য অনেক মানুষের সাহায্য নিয়েছে- বিশেষ করে কালারিংয়ের ক্ষেত্রে । কিন্তু শুটিং পর্যায়ে সে ওয়ান পারসন টেকনলজি ব্যবহার করেছে। তার ফলে এমন কিছু ইমেজ সে ক্যাপচার করতে পেরেছে যে ইমেজগুলো খুব কাজের ইমেজ। আমরা ডকুমেন্টারির ক্ষেত্রে অল্পকিছু চেষ্টা করছি- বেশি চেষ্টা করছি শুটিংয়ে অ্যাডভানটাজটা নেয়া। ডিজিটাল টেকনোলজি আরেকটা নতুন সুযোগ করেছে- অনেক বেশি করে নতুন বাস্তবতা তুলে আনা- যেটা আগে ফিল্ম এ-পর্যন্ত করতে পারেনি। টেকনোলজির কারণেই সেটা সম্ভব হয়নি। সুপার রিয়ালিজমকেও কিন্তু এখন পর্দায় তুলে আনা সম্ভব হয়েছে। এই ব্যাপারগুলোর ছিটেফোঁটা হয়তো কিছু কিছু আমার ছবিতে দেখা যাবে। আমি শিল্পী রফিকুন্নবীর উপর যে ছবিটা বানিয়েছি- স্মৃতির শহর, বেঙ্গল গ্রæপের প্রডাকশনটা। সেখানে আমি এইচডিভি ফর্ম্যাটটাকে ব্যবহার করেছি। তারফলে ইমেজে যে কালার আমি পেয়েছিলাম, কালার রিপ্রডাকশন যেটুকু হয়েছিল- সেটা কিন্তু অনেক আর্টিস্ট দেখে আমাকে বলেছিলেন, এরকম কালার আমরা সিনেমায় দেখি নাই। এটা আমার কৃতিত্ব না। কৃতিত্ব ওই এইচডিভি ফর্ম্যাটের। এইচডিভিতে ধারণ করা ইমেজের রেজুলেশন বেশি, কালার স্যাচুরেশনের মাত্রা অনেক বেশি। যিনি ক্যামেরা পারসন (মাকসুদুল বারী) তিনি লাইটকে প্রপারলি কন্ট্রোল করে ওই কালারটা নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন।
অন্য আরেকটা দিকে, সরকারও কিন্তু সুযোগটা তৈরি করে দিয়েছে। ডিজিটাল টেকনোলজিতে নির্মিত সিনেমা এখন সিনেমা হলে দেখানো যেতে পারে, শোনা যাচ্ছে সরকার কিছু অর্থনৈতিক সহায়তা দেবে সিনেমা হলগুলোকে ডিজিটাল মাধ্যমে কনভার্ট করবার জন্যে- প্রজেকশন টেকনলজিকে ডিজিটাল ফর্ম্যাটে নেবার জন্যে। তার ফলে যেটা হবে যে ডিজিটাল মাধ্যমে তৈরি চলচ্চিত্র ফিল্ম ফর্ম্যাটে ট্রান্সফার না করেও পাবলিক ভিউয়িংয়ের জন্য ট্র্যাডিশনাল সিনেমা হলগুলোতে প্রদর্শন করা যাবে। এই সুযোগটা কিন্তু আমাদের নির্মাতারা, বিশেষত কাহিনীচিত্র নির্মাতারা নিতে পারেন। কিন্তু আমার জন্যে এটা খুব বড় ব্যাপার না। আমার জন্য বড় ব্যাপার হলো এই যে নানা মাধ্যমে ডিজিটাল টেকনোলজি ব্যবহার করা যায় কস্ট ইনভল্বমেন্টটাকে কম রেখে- টেকনোলজির সৃজনশীল ব্যবহার বাড়িয়ে। এটা কিন্তু যেকোনো সাধারণ অডিও-ভিজ্যুয়াল মেকার সেটা করতে পারবেন। ক্যামেরাগুলো এমন যে আপনি চাইলে এখন একটু নাড়াচাড়া করলেই নিজে রিজনেবলি ভালো ছবি ধারণ করতে পারবেন। কম্পিউটার সম্পর্কে ধারণা থাকলে আপনি নিজে সম্পাদনার কাজটা করে ফেলতে পারবেন। অর্থাৎ অনেক ফিল্মমেকারেরই কিন্তু স্বয়ং সম্পূর্ণ হয়ে উঠছেন- সার্বিকভাবে। টেকনোলজির উপর দখল, নিজের ক্রিয়েশনের উপর তার অধিকার প্রতিষ্ঠা; অনেক বেশি সৃজনশীল এবং অনেক বেশি ইনোভেটিভ হওয়ার সুযোগ কিন্তু সৃষ্টি হয়েছে। যেটা দরকার, দেশ-বিদেশের উদাহরণগুলো আমাদের যারা নির্মাতা বা যারা নির্মাণ করতে চান তাদের সামনে যদি নিয়ে আসা যায়- তাহলে এই উদাহরণগুলো আমার মনে হয় তাদেরকে উৎসাহ যোগাবে। এগনেস ভার্দা, যাকে বলা হয় মাদার অব নিউ ওয়েভ- ফরাসি নিউ ওয়েভ; বয়স হয়েছে আশি বছর। কিছুদিন আগে উনার একটা ছবি দেখেছি। উনি এখন যে ছবিগুলো বানাচ্ছেন সেই ছবিগুলো সবই কিন্তু ছোট হ্যান্ডিক্যাম ক্যামেরায়। এই যে গিøনারস এন্ড আই বলে যে ছবিটা আমরা এখানে দেখিয়েছি- সেটা এখন একটা জগদ্বিখ্যাত ছবিতে পরিণত হয়েছে, একেবারে কিন্তু কনজিউমার ভিডিও ফর্ম্যাটের ছবি। এই ধরনের ছবি কিন্ত ট্র্যাডিশনাল ফিল্ম ফর্ম্যাটে শ্যুট করা যায় না। সুতরাং ডিজিটাল টেকনোলজি নতুন সিনেমা বা নতুন অডিও-ভিজ্যুয়াল নির্মাণের একটা সম্ভাবনা তৈরি করেছে, সেটা সিনেমা, অডিও-ভিজ্যুয়াল প্রডাকশন কিংবা ফাইন আর্টের ক্ষেত্রেও হতে পারে। আমি সৃজনশীল প্রকাশের কথা বলছি। এই সুযোগটা আমরা নিতে পারলে আমাদের দেশেও হয়তো চলচ্চিত্র চর্চার একটা নতুন মাত্রা পাবে। আরেকটা সুযোগ সৃষ্টি হবে। আমাদের নানা মাধ্যমের বিশেষত পারফর্মিং আর্টস এবং দৃশ্যমাধ্যমগুলোর সৃজনশীল মানুষদের ইন্টার‌্যাকশনের একটা সুযোগ সৃষ্টি হবে।

ফৌজিয়া: নতুন ফিল্ম অ্যাসথেটিক তৈরিতে বোধহয় ডিজিটাল টেকনোলজি আমাদের হেল্প করতে পারে?
মানজারেহাসীন: হা, অনেকটা। ডিজিটাল ফর্ম্যাটে নতুন প্রকাশভঙ্গি তৈরি করার ক্ষেত্রে টেকনোলজিক্যাল সুযোগটা অনেক বেশি। প্রযুক্তি সহায়তা করতে পারে আপনার ভাবনাটাকে একটা বাস্তব রূপ দিতে।

ফৌজিয়া: এবারে আমরা আবার একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই। আপনি খুব স্কুলিংয়ের কথা বলেন, ফিল্ম স্কুল। কোনো দেশের চলচ্চিত্র বিকাশের জন্য ফিল্ম স্কুলিং কেন জরুরি বলে মনে করেন?
মানজারেহাসীন: প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুবই জরুরি। এমন নয় যে একজন মানুষ স্বশিক্ষিত হয়ে উঠতে পারেন না। যেকোনো মাধ্যমে মানুষ স্বশিক্ষিত হতে পারেন। কিন্তু একটা মাধ্যমের চর্চা যখন অনেক বেশি মানুষ করতে শুরু করেন এবং তার সামাজিক প্রভাব যখন অনেক বেশি বিস্তৃত হতে শুরু করে, সেটা যখন মানুষের রুটি-রুজিরও জায়গায় চলে আসে তখন যদি সেই মাধ্যমকে ইফেক্টিভলি ইউজ করতে হয় তাহলে কিন্তু সেই মাধ্যম সম্পর্কে জানাশোনা মানুষের প্রয়োজনটা তৈরি হয়। এখন একটা স্ট্রাকচারড মাধ্যমে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ তৈরি করা সম্ভব। ব্যক্তি মানুষের উপর যদি ছেড়ে দেন তাহলে নির্ভর করতে হবে সেই মানুষ কবে কখন স্বশিক্ষিত হয়ে উঠবেন তার উপর। সেটা দিয়ে কিন্তু আপনি সামাজিক প্রয়োজন মেটাতে পারবেন না। সামাজিক প্রয়োজন যদি মেটাতে হয় তাহলে আপনার একটা স্ট্রাকচারড অবস্থা থাকা উচিত যেখানে স্বল্প সময়ে প্রয়োজনীয় আয়োজনের মধ্য দিয়ে মানুষ সেই শিক্ষাটাকে গ্রহণ করতে পারে। শিক্ষাগ্রহণটা তো ওইখানেই শেষ না। যেকোনো শিক্ষার ক্ষেত্রে ওই জ্ঞানটা নিয়ে ওই মাধ্যমের সৃজনশীল উন্নতি ঘটাবে, বিকশিত করবে তার নিজের ক্ষমতার মধ্য দিয়ে। এই ধরনের মানুষ আপনি যত বেশি সৃষ্টি করতে পারবেন, তত পসিবিলিটি থাকবে যে একটা মিডিয়াম সম্পর্কে মোটামুটি ধারণাসম্পন্ন মানুষ কর্মক্ষেত্রে আরো বেশি করে ঢুকবে। একটা সাধারণ ধারণা নিয়ে মানুষ কাজ করতে আসবে। তার থেকে কোয়ালিটি যদি সাংঘাতিক ভালো না-ও পাওয়া যায়- মিনিমাম কোয়ালিটি নিশ্চিত করা যাবে। আর উপরের দিকে এর অ্যাডভান্সমেন্টের জায়গা ইজ ওপেন। কারণ অনেক বেশি সংখ্যক মানুষকে আপনি পাচ্ছেন।
সিনেমা তো খালি সৃজনশীলতা না, টেকনোলজির ব্যাপারটাও আছে। এই ধরনের শিক্ষায় হাতে-কলমের ব্যাপারটা আছে। সুতরাং স্বল্প সময়ে সেই স্কিলটাও ডেভেলপ করে যাচ্ছে। আরেকটা দিক হচ্ছে শিয়ার নাম্বার অব পিপল একটা সমাজে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। বড় সংখ্যক ডাক্তার, বড় সংখ্যক ইঞ্জিনিয়ার, বড় সংখ্যক আর্কিটেক্ট, বড় সংখ্যক শিক্ষক- কমিউনিটির উপস্থিতিও কিন্তু একটা মাধ্যমের সামাজিক প্রভাবকে নিশ্চয়তা দেয় সেই মাধ্যমকে সচল রাখতে, মাধ্যমের প্রভাবকে সচল রাখতে। আপনি চারটা লোক হবেন, দশটা লোক হবেন- এর তো কোনো সামাজিক প্রভাব নেই। আপনি ইন্ডিভিজ্যুয়াল, আইসোলেটেড দ্বীপের মতোন থাকবেন। কেউ আপনাকে গ্রহণ করুক বা না করুক। যখন আপনি একটা কমিউনিটি হবেন- সেই কমিউনিটি তার সব ইতি এবং নেতি নিয়েই কমিউনিটি; সমাজে তার প্রভাবটাও সেই রকম হবে। আমি যদি সিনেমা শিক্ষার প্রশ্নটা আনি তখন বলব যে সেটা স্বল্প মেয়াদী হোক, দীর্ঘ মেয়াদী হোক- এটা কন্টিনিউয়াস একটা প্রক্রিয়া। দু’বছর, তিন বছর, চার বছর- কিছু মানুষ এরমধ্য দিয়ে যাবে- বেরুবে, আরো কিছু মানুষ আসবে। চলতে থাকবে এটা এবং তার মধ্যদিয়ে আপনি আস্তে আস্তে একটা কমিউনিটি তৈরি করবেন যে কমিউনিটি আস্তে আস্তে তার স্পেসিফিক সেক্টরে যেন সমাজের বৃহত্তর পরিসরে তার প্রভাবটা বুঝতে পারেন। এটা খুব ইম্পরট্যান্ট। না হলে যেটা হবে কেবলমাত্র ইনডিভিজ্যুয়াল মানুষের ইন্টারেস্ট এবং তার অ্যাবিলিটির উপর একটা মাধ্যমকে তার মরাবাঁচা বা তার বিকাশকে আপনি কন্ডিশনড করে দিচ্ছেন।

ফৌজিয়া: আপনার সাথে যখন থেকে পরিচয়, দেখেছি আমিসহ নতুনদের চলচ্চিত্র নির্মাণে আপনি খুব উৎসাহ দেন, নানানভাবে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়ার চেষ্টা করেন।
মানজারেহাসীন: আমরা যে সময় শুরু করেছি সে সময় খুব কম মানুষই ফিল্ম করেতেন। এটা সাধরণ গাণিতিক ব্যাপার যে আপনি যে কাজটি করছেন এর বিস্তৃতি যদি ঘটাতে না পারেন তাহলে এর কোনো ইমপ্যাক্ট আপনি তৈরি করতে পারবেন না- সেটা সামাজিক ইমপ্যাক্ট হোক, সেটা অ্যাসথেটিক ইমপ্যাক্ট হোক, সেটা পেশাগত ইমপ্যাক্ট- যেটাই হোক না কেন। যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি নতুনদের আপনার ভাবনার চলচ্চিত্র নির্মাণ, চলচ্চিত্র প্রদর্শন, চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করার মধ্যে না আনতে পারেন- ততক্ষণ পর্যন্ত তো আপনি আপনার শক্তি বৃদ্ধি করতে পারবেন না। এটা বলতেই হবে, ইনডিভিজ্যুয়ালি বলি কিংবা সমষ্টিগতভাবে- আমরা একটা আন্দোলনের মধ্যে আছি। অর্থাৎ আমাদের একটা প্রতিপক্ষ আছে যে প্রতিপক্ষ অনেক বেশি সংগঠিত এবং অনেক বেশি শক্তিশালী- আর্থিকভাবে, সামাজিকভাবে এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। তাদের বিরুদ্ধে আপনি তো একক যোদ্ধা হিসেবে বেশিদিন লড়তে পরবেন না। সুতরাং আপনাকে এটার সাথে আরো বেশি মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। আপনার নিজের জেনারেশনের মানুষকে নতুন করে এর মধ্যে সম্পৃক্ত করার কিছু নাই। তারা অলরেডি যার যার মতোন করে তাদের কাজের জায়গা, ভাবনার জায়গা তৈরি করে ফেলেছে। সুতরাং আপনাকে নতুনদের দিকেই তাকাতে হবে। এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আমি মনে করি এটা জারি রাখা দরকার এবং সেই জারি রাখার কাজটা করে যেতে চাই। তবে এই ভাবনার মানুষের সংখ্যা বাড়ানো যেমন দরকার তেমনি সেই মানুষগুলোর কোয়ালিটি একটা ব্যাপার। কোয়ালিটি বলতে কেবলমাত্র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথা বলছি না- তারা ক্রিয়েটিভলি কি করতে পারছে সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেইখানে আমি কেবল ফিল্ম মেকিংয়ের কথাটা বলি না। ফিল্ম মেকিং অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। ওটা চর্চা করার জন্যই বাকি জিনিশগুলো। কিন্তু অনেকের ভাবনা আছে- ভালো ছবি আমি বানাব আর অন্যরা বাকি কাজগুলো করবে। এই ভাবনার জন্যে আমরা অনেক দুর্বল হয়ে যাচ্ছি। এটা হতেই পারে, একজন মানুষ ছবি বানান। ভালো ছবি বানানো যেমন জরুরি তেমনি এর তাত্তি¡কদিকের আলোচনা দরকার, দরকার এর সমালোচনা, এর তাত্তি¡ক ভিত্তিটাকে প্রসারিত করা দরকার, ছবি সম্পর্কে সাধারণ মানুষজনকে শিক্ষিত করা দরকার, দর্শককে এই ভাবনার সাথে পরিচিত করানো দরকার। তারপরে তো ডিস্ট্রিবিউশন, এক্সিবিউশন- এগুলো তো আছেই। কারোর হয়তো নেক আছে লেখার- আবার ছবিও হয়তো সে রিজনিবল বানায়। কিন্তু কেউ যদি মনে করে, আমি ভালো ছবি বানাই আমি অন্যটা করব না- অন্যটা আরেকজন করবে। তখনি সমস্যাটা সৃষ্টি হয়। তখন মনে হয় যে প্রায়োটাটাইজ করা হচ্ছে। আমি মনে করি এটা এমন একটা চলচ্চিত্র ভাবনার ব্যাপার, আন্দোলনের ব্যাপার যেখানে আপনাকে জুতা সেলাই থেকে চÐিপাঠ করার মানসিকতা নিয়েই নামতে হবে। এটা যদি আমাদের বুঝের মধ্যে থাকে তাহলে সমস্যাটা হবে না। যখন যেটা প্রয়োজন তখন সেই এনার্জিটা সেখানে ডিভোট করতে পারবেন। সেটাই দরকার। তা না হলে এটা কোনো বিশেষ প্রভাব রাখতে পারবে না সমাজে। নতুনদের কর্মক্ষমতা বেশি থাকে, নতুন চিন্তাভাবনা থেকে। শুধু চলচ্চিত্র আন্দোলন না- যে কোনো আন্দোলন- সামাজিক আন্দোলন, রাজনৈতিক আন্দোলন, সাংস্কৃতিক আন্দোলন সবাই চাইবে নতুন বøাড যেন সেখানে সম্পৃক্ত হতে থাকে। সেটাই আন্দোলনকে ভবিষৎমুখী করার নিশ্চয়তা দেবে, আন্দোলনটার স্থায়ীত্ব তাতে দীর্ঘমেয়াদী হবে।

ফৌজিয়া: আমাদের দেশে এখন টেলিভিশনের যে বিস্তার ও প্রভাব- সেটা ইনডিভিজ্যুয়াল ফিল্মিক এক্সপ্রেশনের জায়গাটা নষ্ট করছে বলে আমার ধারণা। আপনার কি মনে হয়?
মানজারেহাসীন: আমাদের একটা ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে; যেহেতু টেলিভিশন সিনেমা দেখায়, টেলিভিশন সিনেমা নিয়ে আলোচনা করে- তো টেলিভিশন আমাদেরকে উদ্ধার করে দেবে। আমাদের ছবি নিয়ে সিনেমা হলে যেতে পারি না- টেলিভিশন আমাদের ছবি দেখাবে। কোনো কোনো দেশে কিছু ফিল্মের বিকাশের ক্ষেত্রে টেলিভিশন একটা সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। সেটাও খুঁজলে দেখা যাবে পাবলিক টেলিভিশন- যার অন্তত ঘোষিত দায়টা হচ্ছে সামাজিক পরিসেবা দেয়া। কর্মাশিয়াল টেলিভিশন কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও শিল্পের অন্য শাখার ক্ষেত্রে দায়বদ্ধ নয়- সেটার জন্য তেমনভাবে কাজ করে না। বাংলাদেশে আমরা এখন যে টেলিভিশন দেখছি সেটা মূলত কর্মাশিয়াল টেলিভিশন। সে টেলিভিশনের অনেক উন্নতি আছে। যদি আমরা সত্তর, আশি, নব্বই দশকের বাংলাদেশ টেলিভিশনকে চিন্তা করি- সেটা পাবলিক টেলিভিশন। তার প্রেজেন্টেশন, তার টেকনোলজি, প্রোগ্রাম ডাইভারসিটির ক্ষেত্রে এখনো আমি মনে করি না যে বাংলাদেশ টেলিভিশন-এ যত ধরনের প্রোগ্রাম আছে কোনো প্রাইভেট টেলিভিশনে সেটা আছে। উপস্থাপনা এবং প্রযুক্তিগত দিক হয়তো সেই মানের নেই- সেটা অন্য কথা। পাবলিক টেলিভিশনের ঘোষিত সামাজিক দায়বদ্ধতা আছে। সেটা সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত- এটা হয়তো ঠিক। কিন্তু আমাদের দেশে এখন যে টেলিভিশন নিয়ে আমরা গর্ব করি সেই টেলিভিশন কিন্তু মূলত বাণিজ্যিক টেলিভিশন। এই টেলিভিশনে মানুষ যেটা বেশি করে দেখতে চাইবে এবং তাদের যে ইনভেস্টমেন্ট সেটার বেশি প্রফিট হবে, তাদের সামাজিক শক্তি বৃদ্ধি করবে- তারা কিন্তু সেই রকমের অনুষ্ঠান করবে। যারা ঘোষিতভাবে প্রোগ্রাম নির্ভর টেলিভিশন তারাও কিন্তু নিউজ বড় আকারে প্রচার করছে। কারণ নিউজ বিক্রি হয়। নিউজের শুরু বিক্রি হয়, শেষ বিক্রি হয়, মধ্য বিক্রি হয়, বিরতি বিক্রি হয়। এখন তো প্রত্যেকটা সেগমেন্ট আলাদা আলাদা করে বিক্রি হচ্ছে। সেই কারণেই কিন্তু নিউজ প্রাধান্য পাচ্ছে।
কিন্তু এটাও আমাদের বুঝতে হবে সেই নিউজের রিয়েলিটি প্রাধান্য সিনেমা- সেটা ডকুমেন্টারি বা ফিকশন হোক- সেই সিনেমা তো এরা দেখাবে না। কারণ নিউজের চাহিদা আর এই সিনেমার মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। যে দর্শক নিউজ দেখতে আগ্রহী সেই দর্শক ইনডেপথ নিউজের একটা ডকুমেন্টারি কিন্তু দেখবে না। কারণ প্রয়োজনটা আলাদা। ওরা এক ধরনের অডিও-ভিজ্যুয়াল তৈরি করছে যেটা টেলিভিশনের চাহিদার সাথে বা চরিত্রের সাথে মেলে। তারা তাৎক্ষনিকতাকে অ্যাড্রেস করতে চাচ্ছে, তারা এন্টারটেইনমেন্ট আসপেক্টটাকে প্রমোট করতে চাচ্ছে। সেইখানে আমরা যে সিনেমার কথা ভাবি- সেটা ফিকশন হোক, ডকুমেন্টারি হোক- কোনো সিনেমাই টেলিভিশনে সেই অর্থে প্রাধান্য পাবে না। ওরা পৃষ্ঠপোষকতা ওই অর্থে করবে না। কিন্তু সিনেমা ওখানে থাকবে। কারণ সিনেমা ইজ পার্ট অব দ্য সোসাইটি। সোসাইটির ইভেন্টস, এলিমেন্টসগুলোকে কোনো না কোনোভাবে তাদেরকে আনতে হবে- তারা আনে। খেয়াল করলে দেখবেন, প্রত্যেক চ্যানেলে সিনেমার প্রোগাম আছে। কিন্তু কোন সে সিনেমা? সেটা মূলধারার বাণিজ্যিক সিনেমা। কারণ তারা দর্শককে বেশি আনন্দ দিতে চায় ওই অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে। আমি তো মনে করি টেলিভিশন এখন আর আমাদের ধারার সিনেমার প্রতিদ্ব›দ্বী নয়। খুব টেকনোলজি-নির্ভর বা ডিটেল ভিজ্যুয়ালসমৃদ্ধ সিনেমার প্রতিদ্ব›দ্বী সে না। কারণ টেলিভিশন সেটা করতে পারবে না- দেখাতেও পারবে না, করতেও পারবে না। দেখালেও যেভাবে তার প্রেজেন্টেশন দরকার সেটা টেলিভিশন করতে পারবে না। এখন আমাদের যেটা দরকার, টেলিভিশনের ভিজ্যুয়াল এবং সাউন্ডের থেকে আমাদের ভিজ্যুয়াল-সাউন্ডের চরিত্রগত পার্থক্য নির্ধারণ করা। সেটা যদি করা যায় তাহলে দুই ধরনের ভিজ্যুয়ালের জন্য দুই ধরনের দর্শক তৈরি হবে। আমি তো মনে করি এখনকার সিনেমা অনেক বেশি করে ভিজ্যুয়াল সিনেমা হওয়া উচিত- রাদার দ্যান অডিও সিনেমা; অডিওটাকে এখন যদি চারিত্রিককভাবে আলাদা করে দেখা যায়, ভিজ্যুয়ালকে প্রাধান্য দেয়া যায়। টেলিভিশন এটা পারবে না। টেলিভিশন এখন অনেক বেশি করে অডিও-নির্ভর হচ্ছে।

ফৌজিয়া: ওই জিনিসটাই আমি বলছিলাম, টেলিভিশনের সংখ্যা কিন্তু আমাদের অনেক বেড়ে গেছে বা যাচ্ছে এবং টেলিভিশনে অডিও-নির্ভর ভিজ্যুয়াল। অডিও-নির্ভর ভিজ্যুয়ালের চর্চা আমাদের সমাজকে এমনভাবে প্রভাবিত করছে যে ভিজ্যুয়াল-নির্ভর যেরকম সিনেমার কথা আমরা বলছি তা নির্মাণের চর্চা কমে যাচ্ছে।
মানজারেহাসীন: প্রভাবিত কিন্তু করবেই। টেলিভিশন ঘরের মধ্যে বিশ্বটাকে নিয়ে আসছে। আগে আপনি সিনেমা দেখতেন বড় পর্দায়- সিনেমা হলে না যাওয়া পর্যন্ত সিনেমার ভিজ্যুয়ালের সাথে পরিচয় হতো না। টেলিভিশনে যখন ভিজ্যুয়াল দেখছেন সেটা সিনেমার ভিজ্যুয়াল নয়। টেলিভিশনে যখন সিনেমা দেখানো হচ্ছে তখন সিনেমা দেখার আয়োজনটা আপনার নাই এবং সেটা দেখছেন আপনি চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এক বা দেড় ঘণ্টা। বাকি চব্বিশ ঘণ্টা কিন্তু আপনি অন্য ধরনের ভিজ্যুয়াল দেখছেন যেটা একদম ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে বয়স্ক মানুষ পর্যন্ত দেখছে। দিনের পর দিন ওই ভিজ্যুয়াল দ্বারা আপনি প্রভাবিত হচ্ছেন। আপনি চান বা না চান ওই ভিজ্যুয়ালের ইমপ্যাক্ট অনেক বেশি। সেখান থেকে আপনার সরে আসার যে প্রক্রিয়া এই প্রক্রিয়টা খুব সচেতনভাবে নিতে হবে। এটা খুব সহজ প্রক্রিয়া না। যে মানুষ ভিজ্যুয়ালের সাথে পরিচিত হয়েছে কিন্তু সেই অর্থে নানা ভিজ্যুয়াল দ্বারা এডুকেটেড না তাকে যদি আপনি অন্য ধরনের ভিজ্যুয়াল দিতে পারেন- সেই আমেজটা, মজাটা তার মধ্যে সঞ্চারিত করতে পারেন তখন কিন্তু সে সেই ভিজ্যুয়ালটার প্রতি আকৃষ্ট হতে বাধ্য। প্রশ্ন হচ্ছে আমরা সেই ভিজ্যুয়াল তৈরি করতে পারছি কিনা, সেই ল্যাঙ্গুয়েজ তৈরি করতে পারছি কিনা। এখন কিন্তু দুটো সম্ভাবনা আছে; একটা হচ্ছে, টেলিভিশনের ল্যাঙ্গুয়েজ সিনেমাতে নিয়ে আসা। যেটা আমাদের দেশে কিছু কিছু হয়েছে। এই যে মোস্তাফা সারওয়ার ফারুকী বা নতুন যারা টেলিভিশন থেকে সিনেমায় যাওয়ার চেষ্টা করছে- দেখা গেছে ওরা ইফেক্টিভটি টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রিক ভাষার বø্যান্ডটা করতে পারেনি। যার ফলে ওদের নাটক যত পপুলার, তাদের সিনেমা তত পপুলার না। এটাও কিন্তু একটা জায়গা। কারণ মনে রাখতে হবে, টেলিভিশনে যে ভিজ্যুয়াল প্রতিদিন চব্বিশ ঘণ্টা দেখছেন সেই অডিও-ভিজ্যুয়ালের প্রভাব আপনার মানসিক জগতে পড়বে না এটা তো হতে পারে না। এই উপাদানগুলোকে সিনেমাতে আপনি নতুনভাবে ব্যবহার করবেন- এটা যদি করতে পারেন তবে সিনেমার ভিজ্যুয়ালও সমৃদ্ধ হবে। উল্টোটা হওয়া এখন অসম্ভব। কারণ সিনেমার ভিজ্যুয়াল ইজ নট ডমিন্যান্ট ভিজ্যুয়াল, টেলিভিশনের ভিজ্যুয়াল ডমিন্যান্ট ভিজ্যুয়াল। এটা হতে পারে যে, ক্রিয়েটিভ ট্রান্সফরমেশন অব টেলিভিশন ল্যাঙ্গুয়েজ টু সিনেমা অন স্ক্রিন। আরেকটা যেটা হতে পারে, টু ক্রিয়েট নিউ কাইন্ড অব অডিও-ভিজ্যুয়াল হুইচ ইজ ডিসটিংটিভলি ডিফারেন্ট ফ্রম টেলিভিশন। তাহলে এক ধরনের মানুষ আকৃষ্ট হবে- তারা হয়তো অল্প মানুষ।
আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, আব্বাস কিরোস্তামী (ইরানের চলচ্চিত্রকার) টাইপের সিনেমা- টাইপ বলতে বোঝাচ্ছি এমন ভিজ্যুয়াল যেটা টেলিভিশন দেখতে পারবে না কিন্তু আপনার মনে হবে রিয়েলিটি আমি দেখছি। ওটার জন্য আলাদা ট্যালেন্ট লাগে, আলাদা যোগ্যতা লাগে ওই ধরনের ভিজ্যুয়াল তৈরির জন্য। কিন্তু ইট লুকস ভেরি ইজি। ওই রিয়েলিটি আর টেলিভিশনের রিয়েলিটির মধ্যে আকাশপাতাল পার্থক্য। এমন দর্শক তৈরি করতে হবে যে ওই রিয়েলিটিকে রিড করতে পারবে- এটা একটা বড় টাস্ক। সেই দায়িত্ব কিন্তু চলচ্চিত্র বিষয়ক সব সংগঠনের।
টেলিভিশনকে আমি খাটো করছি না, টেলিভিশন খুব ইমপরট্যান্ট একটা মিডিয়াম। টেলিভিশনকে ওই রোলটাই প্লে করতে দিই আমরা। টেলিভিশনের রোলে দাঁড়ানোর প্রয়োজন নাই আমাদের। আমি তো মনে করি দুই ধরনের সিনেমা হবে- যে ধরনের সিনেমা টেলিভিশন কোনোদিন বানাতে পারবে না- থ্রিডি টাইপের সিনেমা, কম্পিউটার জেনারেটেড ইমেজ; আরেক ধরনের সিনেমা হবে অনেক বেশি বাস্তবতার কাছাকাছি। কিন্তু সেই বাস্তবতাটা টেলিভিশনের বাস্তবতা না, রিয়েলিটি শোর বাস্তবতা না। এটা টেকনোলোজির সাহায্যে অনেক গভীর এবং আন এক্সপোজড বাস্তবতা। বাস্তবতা, বাস্তবতার বাইরের কিছু না; এবং বাস্তবতার একটা নতুন ইন্টারপ্রিটেশন। এখনকার সময়ে এই দুই ধরনের সিনেমার পসিবিলিটি আছে। আমরা যেহেতু ওই টেকনোলোজি বেজড সিনেমা বানাতে পারব না- কারণ ওটা খুব অ্যাডভান্সড টেকনোলোজির ব্যাপার, হিউজ ইনভেস্টমেন্টের ব্যাপার যেটা আমাদের বাণিজ্যিক ধারার সিনেমার পক্ষেও সম্ভব না ওই ইনভেস্টমেন্ট এবং ওই টেকনোলোজি হাতের নাগালে পাওয়া। তাহলে আমাদের দ্বিতীয় ওই ধরনের সিনেমা বানানোর দিকেই মনোযোগ দেয়া উচিত বেশি করে।

ফৌজিয়া: ইদানিং ভারতীয় চলচ্চিত্র বাণিজ্যিকভাবে সিনেমা হলে প্রদর্শন করা নিয়ে আমাদের এখানে বেশ তর্ক-বিতর্ক চলছে। আপনার কি অভিমত এতে?
মানজারেহাসীন: ভারতের ব্যাপারটা আমাদের কাছে দুইভাবে- আমি মনে করি এটার সাথে ঐতিহাসিক ব্যাপার যুক্ত আছে। সোজাসাপটা রাজনীতির ব্যাপারটা যুক্ত আছে। প্রতিবেশি দেশ সম্পর্কে আরেকটা দেশের মূল্যায়নের ব্যাপারটা যুক্ত আছে। ভারতীয় চলচ্চিত্র কিন্তু ভারত থেকে আলাদা কোনো কিছু না। ভারত একটা বৃহৎ রাষ্ট্র। ভারতের অর্থনীতি অগ্রসরমান। সব অর্থেই ভারত একটি শক্তিশালী দেশ। সুতরাং আমাদের মতোন ছোট দেশের এক ধরনের ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স আছে। খারাপ অর্থে বলছি না- এটা যেকোনো দেশেরই হতে পারে। চীনের পাশে মঙ্গোলিয়া, তাদেরও কিন্তু এটা আছে, কারণ সে জানে সে বড় হতে চাইলেও হতে পারবে না; ওকে ছাড়িয়ে যাওয়া সম্ভব না। রাশিয়ার পাশে পোলান্ডের এই সাইকোলজিক্যাল ব্যাপারটা থেকেই যাবে।
আমাদের দেশের চলচ্চিত্রের জায়গায় যদি এটা ধরি- চলচ্চিত্র কেন যে কোনো মাধ্যমের ক্ষেত্রে আপনি ভাবতে পারেন অন্য কোনো দেশের কোনো কিছু আমি দেখব না, পড়ব না, শুনব না। এটার পজিটিভ কোনো দিক থাকতেও পারে। কিন্তু বেশিরভাগটাই নেতিবাচক। কারণ আজকে যদি বলা হয় আমি বাংলা ভাষার অন্য কোনো বই আর পড়ব না- কেবল বাংলাদেশের বই-ই পড়ব। তাহলে আপনি নিজেকেই সংকুচিত করে দেবেন- বাংলা ভাষার চর্চাটাকে সংকুচিত করবেন, আপনার জ্ঞানের ভান্ডারটাকে সংকুচিত করবেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ভারতীয় সিনেমা কি তাই- সাধারণ অর্থে ভারতীয় সিনেমা সেটা না। ঢালাওভাবে ভারতীয় সিনেমা আমদানি কেউ সমর্থন করবে না। ভারতীয় সিনেমা আমদানি বন্ধ করার পিছনে যে যুক্তিটা ছিল সেই যুক্তিটা আমি মনে করি হিডেন এজেন্ডা ছিল রাজনৈতিক। আর অ্যাপারেন্টলি যে এজেন্ডাকে সামনে দেওয়া হয়েছিল- বলা হয়েছিল যে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে প্রাথমিকভাবে প্রতিযোগিতার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য, যাতে প্রতিযোগিতা থেকে বেঁচে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে। একটা ইন্ডাস্ট্রি প্রতিযোগিতা ছাড়াই তার প্রাথমিক ভিতটা গড়তে পারে। কিন্তু আনফরচুনেটলি আমরা সেটা তো পাই নাই। যদি বলি ১৯৬৫ সাল থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর ভারতীয় সিনেমাকে আমদানি হতে দেই নাই। কিন্তু আমরা কি পেয়েছি? এখন তো বলবই আমাদের সেই সো কলড সিনেমা প্রায় ধ্বংসের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। এটার জন্য কি ভারতীয় চলচ্চিত্র দায়ী? বা অন্য কোনো দেশের চলচ্চিত্র দায়ী? নাকি যে চলচ্চিত্রকে প্রটেক্ট করা হয়েছে সেই চলচ্চিত্রের যারা সবচেয়ে অ্যাডভান্সড প্লেয়ারস- প্রযোজক, পরিচালক, প্রদর্শক, হল মালিক এবং কলাকুশলী- কারা বেশি দায়ী? নাকি দর্শক দায়ী, নাকি সরকার দায়ী- সরকার মানে সরকারের নীতিমালা দায়ী? যদি বেশি করে দেখি যে দেখব আগের মানুষগুলোই বেশি করে দায়ী বা সেই গোষ্ঠিটাই বেশি করে দায়ী। এখন যারা মনে করছেন যে প্রতিযোগিতার মধ্যে ফেলতে চান- তারাও যে ইতিবাচক অর্থে প্রতিযোগিতার মধ্যে ফেলতে চাচ্ছেন তা কিন্তু না। তারা মূলত একটা ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাপারটা দেখছেন। এটার পেছনে কারা আছে? যতদূর জানা গেছে- ডিস্ট্রিবিউটর এবং হল মালিকরা। কেন? তাদের ধারণা যে ভারতীয় ছবি হিন্দি ভাষায় হলেও তার একটা দর্শক আছে, যদি হিন্দি ছবি আনা যায় তবে আমাদের হল টিকবে এবং আমাদের ব্যবসা টিকবে। এটা তো যেকোনো ব্যবসায়ীই করবেন। আজকে যদি কেউ দেখে যে ইন্দোনেশিয়া থেকে বিস্কুট আনলে বেশি বিক্রি হবে যে তাহলে তার জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেম বাদ দিয়ে ইন্দোনেশিয়া থেকে সেটা নিয়ে আসবে এবং সেটা কিন্তু হচ্ছে। ব্যাপারটা হচ্ছে কোন পক্ষে দাঁড়িয়ে আপনি জিনিসটা দেখছেন। আমার ক্ষেত্রে যদি বলেন- আমি দুইটা জায়গায় জিনিসটা দেখতে পারি। একটা জায়গা হলো, ভারতীয় সিনেমা এজ ফিল্মমেকার বা এজ ফিল্ম অ্যাকটিভিস্ট আমাকে কোনোভাবে প্রভাবিত করছে কিনা। ভারতীয় বাণিজ্যিক সিনেমার প্রতি আমার ব্যক্তিগত কোনো আকর্ষণ নেই। সুতরাং ভারতীয় সিনেমা থাকলেও আমার ব্যক্তিগত চর্চা কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত হবে বলে মনে করি না, আমাদের ধারার চলচ্চিত্র চর্চা কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত হবে না। আমরা যে সম্ভাব্য দর্শকের কথা ভাবছি- ভারতীয় সিনেমা কি আমাদের প্রবাবল দর্শকের রুচিবোধকে কি পরিবর্তন করে দেবে? আমার মনে হয় যে সেটা হবে। কারণ সেই দর্শক কিন্তু অনেক বেশি করেই ওয়ার্ল্ড সিনেমায় এক্সপোজড। সুতরাং আমার ভয়ের কিছু নাই। ভয় কাদের আছে- যারা ভারতীয় সিনেমার অনুকরণে সিনেমা বানায়। কারণ দর্শকের কাছে তখন জিনিসটা এমন হবে যে আমি আসলটা নেব না নকলটা? তাদের জন্যেই ভয়। তারা বলছেন যে, হা আমরা ওদের মতোন করে ছবি বানাতে পারতাম যদি আমাদের মার্কেট অত বড় হতো, অত ইনভেস্টমেন্ট পেতাম, ওই টেকনোলজি আসত। সেই টেকনোলজি আমাদের কোনোদিনই আসবে না। কারণ আমরা ভারতীয় সিনেমার যে ট্র্যাডিশনাল বাজার, তার যে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড বাজার, তার যে টেকনোলজি- এটা তো একদিনে তৈরি হয় নাই। সেটা ওভার দ্য ইয়ারস তৈরি হয়েছে। সেটা সত্তর বছরের বেশি। সুতরাং সেইখানে প্রতিযোগিতার প্রশ্নটা আসে না। অন্য উদাহরণ কিন্তু পৃথিবীর দেশে দেশে আছে। অন্য দেশের ছবি এসেও স্বদেশের ছবি যদি স্বদেশকে সত্যিকারে রিয়েলিস্টিক ওয়েতে পোট্রে করে সে দেশের মানুষের জীবন, সংগ্রাম, জীবন যাত্রা, সংস্কৃতি- তাহলে কিন্তু সে দেশের মানুষ প্রাথমিকভাবে নিজের দেশের ছবিই দেখে। আমাদের বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্র সেটা করতে পারেনি- প্রটেকশন দেওয়ার পরও। এখন যদি বলে আরো প্রটেকশন বিশ বছর দাও- এই কমিটমেন্ট কি তাদের কাছ থেকে পাওয়া যাবে যে না থুক্কু দিলাম এরপর থেকে আমরা সত্যিকারের চলচ্চিত্র নির্মাণ করব! এটা আসলে করা যাবে না। কারণ আমরা একটা মার্কেট ইকোনোমির মধ্যে আছি। আপনি এইভাবে ডিক্টেড করতেও পারবেন না। সুতরাং এটা একটা খুব জটিল প্রসঙ্গ। আর কিছু রাজনৈতিক বক্তা আছেন- তারা বলেন এটা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। এটা একটা প্রশ্ন বটে। আমি টেলিভিশন দেখছি, আমাদের দৈনিক পত্র-পত্রিকার সিনেমার পাতায় বলিউডের সিনেমা নিয়ে দুই পাতা করে ছাপাচ্ছি, লিখছি, আমার বলিউড সিনেমার অনুকরণে নির্মিত সিনেমা থাকছে; সেইটা সব থাকবে আর সিনেমা আমদানি বন্ধ করলেই কি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বন্ধ হয়ে যাবে? তাহলে এইখানে কিছু গÐগোল আছে। আমি মনে করি সুস্থ প্রতিযোগিতার স্বার্থে ভারতীয় কেন যেকোনো দেশের চলচ্চিত্র আমদানি করতে দেয়া উচিত। কিন্তু সেখানে একটা বিচারবোধ থাকার প্রয়োজন আছে। হরেগরে আমদানি করতে পারবে না। সেটা নাম্বারের দিক থেকে সীমিত হতে পারে, সেটা একটা কমিটির মধ্য দিয়ে স্ক্রিনিং হতে পারে যে কোন ধরনের চলচ্চিত্র আমরা আমদানি করতে চাই। তার মধ্যদিয়ে আমাদের চলচ্চিত্র- বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রকে সাবালত্বের দিকে যাওয়ার ক্ষেত্রে একটা প্রতিযোগিতার দিকে যাওয়া উচিত। আপনার পাশে যদি আরেকটা লোক ঠিকমতো না দৌড়াতে পারে সেটা যদি অনুপস্থিত থাকে তাহলে আপনি হেঁটে হেঁটে কচ্ছপের মতোন লম্বা দৌড় দিতে পারেন। সেটাই করছি আমরা। তাও কচ্ছপ তো শেষ পর্যন্ত পৌঁছেছিল। আমরা সেখানেও যেতে পারছি না গত পঞ্চান্ন বছর ধরে। তো এই দৌড়ের তো কোনো অর্থ হয় না। এমন একজন প্রতিযোগি আনেন যারদিকে আপনি দুইবার তাকাতে পারবেন। তারপরে আপনি দেখতে পাবেন- আপনার স্পিডটা বাড়াতে হবে নাকি কমাতে হবে। হরেগরে আমদানি করাটাও ঠিক নয়- একেবারে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেই কেবল আমদানি করাটাও উচিত হবে না। আবার আরো কিছু বছরের জন্য প্রটেকশন দেওয়ারও কোনো অর্থ নাই। কেবলমাত্র একটা সেক্টরে প্রটেকশন দিয়ে ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে টিকিয়ে রাখতে পারবেন না। যেখানে আপনি ওপেন মার্কেট ইকোনোমির কথা বলছেন, গেøাবালাইজেশনের কথা বলছেন; ভালো-খারাপ তো অন্য কথা।

ফৌজিয়া: আপনি খুব এক্সপেরিমেন্টাল ছবির কথা বলেন। কিন্তু আপনার ছবি আবার বেশ ন্যারেটিভ- সচরাচর আমরা যেমন দেখি। ব্যাপারটাকে আপনি কিভাবে দেখেন?
মানজারেহাসীন: অনেক বেশি ন্যারেটিভ- এই কথাটাতে ঠিক অতটা সায় নেই আমার। অই অর্থে নিরীক্ষাধর্মী ছবি- সেটা তো আমি বানাই নাই। কেবলমাত্র ফর্মের এক্সারসাইজ চলচ্চিত্রের ভাষা নিয়ে, দৃৃশ্য নিয়ে বা শব্দ নিয়ে- সেই ধরনের ছবি নির্মাণ করতেও চাই নাই কখনো। আমি চেয়েছি এমন একটা চলচ্চিত্র ভাষা তৈরি করতে যেখানে পুরোনো ফর্মের মধ্যেই নতুন নতুন কিছু অনুষঙ্গ যুক্ত করা যায়। কতটা সফল হয়েছি জানি না। শুরুর দিকের ছবির কথা যদি বলি- যে কাজটা প্রথম শুরু করেছিলাম সেটা অপরাজিতা- সুফিয়া কামালের জীবনীমূলক ছবি। সেটি এক ধরনের ন্যারেটিভ, ন্যারেটিভ বলতে যদি বলি সাদামাটা গল্প বা ধারাবাহিকতা রেখে একটা ছবি করা- সেটা আছে। কিন্তু আমার পরের কিছু ছবি- জানি না সবটা আপনার দেখা হয়েছে কিনা, আমার মনে হয় যে বিল ডাকাতিয়ার বৃত্তান্ততে কিছু অন্যরকম কাজ ছিল। কিছু কিছু অংশ ছিল যেগুলো ঠিক ওইভাবে সচরাচর যেমন ন্যারেটিভ হয় তেমন বলা যাবে না। যেমন ধরেন, বিল ডাকাতিয়ার বৃত্তান্ততে সাবজেক্টিভ ভিউকে আমি খুব সরাসরি এনেছি। এটা যে নতুন কিছু তা না- বিশ্ব সিনেমায় এই ট্রিটমেন্ট আছে। বিল ডাকাতিয়ার বৃত্তান্ত-র বিষয়টা যদিও অনেক বেশি করে ডিমান্ড করে একটা অবজেকটিভ রিপ্রেজেন্টেশন। কারণ পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা আমি বলছি এই ছবিতে- এটা অবজেকটিভ রিপ্রেজেন্টেশনই অনেক বেশি করে ডিমান্ড করে। কিন্তু আমি ভিজ্যুয়ালি অবজেকটিভ থেকে কমেন্ট্রিতে সাবজেক্টিভ ভিউটাকে ইমপোজ করতে চেষ্টা করেছি। সেই কমেন্ট্রি একজন ফিল্মমেকারের সাবজেক্টিভ পারসপেকটিভ থেকে পারসোনাল মনোলগের মতোন করে এসেছে, প্রথাগত কমেন্ট্রির মতোন না। খেয়াল করলে দেখবেন, সেই অর্থে সাধারণত যেমন পাঠ করতে ভালো পারে, ভালো গলা- ওরকম কোনো মানুষকে ধারাভাষ্য পাঠের জন্য ব্যবহার করি নাই। আমার বন্ধু চলচ্চিত্রকার ফরিদুর রহমান- তাকে দিয়ে আমি ওটা পাঠ করিয়েছিলাম। কিছু কিছু জায়গায় দৃশ্য- বিশেষত সংগীতের ব্যবহারে আমি চেষ্টা করেছি একটু অন্যভাবে করতে।

ফৌজিয়া: কি রকম সেটা?
মানজারেহাসীন: আমি চেষ্টা করেছি সঙ্গীতের ব্যবহার সব সময় যাতে ইলাস্ট্রেটিভ না হয়। দু’ভাবেই হতে পারে, আপনি ধারাভাষ্য দিয়ে একটা দৃশ্যকে বর্ণনা করতে পারেন বা বর্ণনা করার জন্য কমেন্ট্রিকে ব্যবহার করতে পারেন। আরেকটা হতে পারে- কমেন্ট্রি বা সাউন্ডকে আপনি একটা আরেকটার পরিপূরক হিসেবে দেখতে পারেন; মানে একটা আরেকটাকে কম্পিøমেন্ট করছে। কোনোটাই সরাসরি সেটাকে বর্ননা করছে না। সেটা দৃশ্যও দিয়েও না, শব্দ দিয়েও না। তো এই ব্যাপারগুলো কিছুটা চেষ্টা করেছিলাম বিল ডাকাতিয়ার বৃত্তান্ততে । বিশেষত শেষে যে গানটা আছে সেটা ওখানকার এক ভদ্রমহিলার কণ্ঠে গাওয়া। আমি বরাবরই চেষ্টা করেছি কণ্ঠ সঙ্গীত ব্যবহার করতে- আমার ছবিতে ওটাই মূলত সঙ্গীত। যন্ত্রসঙ্গীতের ব্যবহার আমার ছবিতে কম। একমাত্র অপরাজিতাতে যন্ত্রসঙ্গীতের ব্যবহার একটু উচ্চকিত। কণ্ঠসঙ্গীতের ব্যবহার বেশি এবং আমি ইন্সট্রুমেন্ট বাদ দিয়ে কণ্ঠসঙ্গীত ব্যবহার করার চেষ্টা করছি। আমার কাছে মনে হয়েছে দৃশ্যের সাথে শব্দের যোগটা বিশেষত ইন্সট্রুমেন্ট্রাল সাউন্ডের যোগ সবসময় যে খুব যায় তা না। রিদমিক নয়- কিন্তু আবার একধরনের মেলোডিয়াস সাউন্ড সেটা অনেক বেশি ইফেক্টিভ বলে মনে হয়। একটা উদাহরণ দেই। সত্যজিত রায়ের কাঞ্চনজঙ্ঘা-র শেষ দৃশ্যে নেপালী একটা সঙ্গীত আছে- বাচ্চা ছেলের গলায়। এর আগে কিন্তু অনেক যন্ত্রসঙ্গীতের ব্যবহার আছে এবং সত্যজিতের সঙ্গীত তো খুবই উন্নতমানের সঙ্গীত। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় ওই সঙ্গীতটা যত ইফেক্টিভলি ব্যবহৃত হয়েছে- ওই বাচ্চার গলায় গানটা- কোনো ধরনের যন্ত্রানুষঙ্গ ছাড়া; সেটা টোটাল পরিবেশটাকে- যে গল্পটা আমরা দেখলাম, যে কাহিনীটা ঘটে গেল সেই কাহিনীর একটা নির্যাস যেন ওই নেপালী গানটাতে। যদিও শব্দগুলো আমরা বুঝতে পারি না- কারণ নেপালী ভাষা, সবটা বোঝা যায় না। এটা প্রায় সব ছবিতে আমি চেষ্টা করছি। আমি সঙ্গীত ব্যবহার করছি কিন্তু সঙ্গীতকে যন্ত্রসহযোগে যেভাবে সঙ্গীত হয় সেভাবে ব্যবহার করিনি। দু’একটা ব্যতিক্রম ছাড়া যেখানে পরিপার্শ্বের অংশ হিসেবে গানটা আসছে সেখানে যদি ইন্সট্রুমেন্ট থাকে সেটা তো থাকেই। তাছাড়া কিন্তু আমি যন্ত্রানুষঙ্গে গান ব্যবহার করি না।
আমার রোকেয়া যদি দেখেন- রোকেয়া-র কমেন্ট্রিতেও সাবজেক্টিভ ট্রিটমেন্ট আছে। রোকেয়া-র টেকনিক্যাল এক্সিকিউশন অনেক দুর্র্র্র্র্র্বল- বিশেষত সাউন্ড। এটা নিয়ে আমি নিজে খুবই বিব্রত বোধ করি। তারপরও আমার মনে হয় রোকেয়াতে আমি ইফেক্টিভলি কন্সট্রাকটেড ইমেজ এবং ডকুমেন্টারি ইমেজকে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছি। এটাকে আপনি রিকন্সট্রাকশন বলতে পারেন না, কিন্তু ইটস এ কাইন্ড অব কন্সট্রাকটেড ইমেজ- লাইক ফিকশন ইমেজ। এটা ঠিক প্রথাগত রিকন্সট্রাকশন না। কিন্তু এটা নতুন কিছু ক্রিয়েট করছে না- পাস্টকে যে কারণে রিকন্সট্রাক্ট করা হয়- যেমনটা প্রচুর ডকুমেন্টারিতে হয়। রোকেয়া-র কন্সট্রাকটেড ইমেজ পাস্টকে রিক্রিয়েট করছে না, বরং এটা আমাদের সমসাময়িক কিন্তু আবার এটা আবার সমসাময়িক ফিকশনাল ইমেজ না। এটা এমনভাবে করা যে ডকুমেন্টারিটাকেই কনটেম্পোরারি আসপেক্টে উপস্থাপন করছে। কিন্তু এটা আবার ডকুমেন্টারি ইমেজ না। খেয়াল করলে দেখবেন, দুটোর লাইটিং টাইনিং- সব কিন্তু আলাদা। কিন্তু আমি বলব যে বেøন্ডিংটা ভালো হয়েছে। ডকুমেন্টারি ইমেজ থেকে নন-ডকুমেন্টারি ইমেজ মানে কন্সট্রাকটেড ইমেজের ট্রানজিশনগুলো মোটামুটি রিজনিবল হয়েছে। ওভাবে যদি দেখেন তবে এগুলো একটু অন্যরকম। আমি বলব না এগুলো এক্সপেরিমেন্ট এজ সাচ- কিন্তু একটু অন্যভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছি।
আপনি যদি ন্যারেটিভ বলেন, আমি বলব আমার আমাদের ছেলেরা অনেক বেশি করে নন-ন্যারেটিভ সিনেমা। দেয়ার ইজ নো সেন্ট্রাল স্টোরি এজ সাচ। একটা ক্যারেকটারের একটা সেন্ট্রাল স্টোরি আছে কিন্তু সেটাও অনেক বেশি ডিসজয়েন্টড। এই স্টোরিগুলোর রিপ্রেন্টেশনটা অনেক বেশি করে আলাদা। এটা অনেকটা ভাবনার ছবি র‌্যাদার দ্যান অ্যাবাউট স্টোরিজ অব ডিফারেন্ট ক্যারেকটারস। এখানে ভাবনাটারই নানা ভারসনের- অন মাসকোলিনিটি, চরিত্রগুলোর ব্যক্তিগত জীবন। কিন্তু ওটা কোনো ন্যারেটিভ স্টোরির মধ্যদিয়ে যাচ্ছে না বা যেতে চাইলেও একটা পর্যায়ে দেখা যাচ্ছে ট্রানজিশনগুলো- একটা সিকোয়েন্স থেকে যখন আরেকটা সিকোয়েন্স যাচ্ছে তখন এমন অ্যাবরাপ্টলি যাচ্ছে যে একটা ন্যারেটিভ তৈরি হতে গিয়েও ভেঙে যাচ্ছে, সরলসিদা ন্যারেটিভ তৈরি হয় না। কারণ ছবিটা কোনো গল্পও বলে না, কোনো ভাবনার কোনো কংক্রিট ইমেজও দেয় না। কারণ দেয়ার ইজ নো প্রেসক্রাইবড থট অ্যাবাউট মাসকুলিনিটি ইন দিস ফিল্ম। ছবিটা তৈরিই করা হয়েছে এই ভাবনা থেকে যে লেটস থিঙ্ক অ্যাবাউট মাসকুলিনিটি। হোয়াট ইজ মাসকুলিনিটি তার কোনো প্রেসক্রাইবড ফরম্যাট নাই, তার কোনো বাউন্ডারি নাই, এর কোনো ডেফিনিট সংজ্ঞা তৈরি হয় নাই। কিন্তু কিছু নিশ্চয়ই আছে যেটা আমাদের মনোজগতকে নিয়ন্ত্রণ করে, আমাদের চরিত্র গড়ে উঠতে সাহায্য করে, আমাদের অ্যাকশনকে গাইড করে- কনসাসলি অর আনকনসাসলি- সেটা কি, সেটা একটু বোঝার চেষ্টা করা। সেই কারণে কিন্তু আমাদের ছেলেরায় এই জিনিসগুলো করার চেষ্টা করেছি আমি। একটা গল্প বলে দিলাম যে দেখো আমার জীবনে এই হয়েছে- সেটা না। বরং গল্প হয়ে যখন উঠতে চেয়েছে তখন ওই গল্পটাকে ওখানে থামিয়ে দেয়া হয়েছে। এটা ওইভাবে ক্লেইম করারও কিছু নাই- কিন্তু এখন নন ন্যারেটিভ গল্প বলার যে স্টাইল নানান মিডিয়ামে তৈরি হয়েছে- বিশেষত সাহিত্য এবং চলচ্চিত্রেও, তার কাছাকাছি যাওয়া। আবার এটা করার জন্যই ছবির ট্রিটমেন্ট অমন করেছি তা কিন্তু না।
আপনি যদি আমার চারুকলায় মুক্তিযুদ্ধ দেখেন তাহলে দেখবেন যে ওখানে ভিজ্যুয়াল এক্সপেরিন্টেশনটা একটু বেশিই আছে। একটা হিস্টোরিক্যাল পাস্ট এবং তার ইমপ্যাক্টকে আপনি কি করে রিলেট করবেন- সরাসরি ইমপ্যাক্ট না, একটা ক্রিয়েটিভ মাধ্যমে তার রিফ্লেকশনটা- এটা তো সরাসরি কিছু নাই। একই ধরনের ব্যাপার করার চেষ্টা করেছিলাম- শিল্পী হাশেম খানকে নিয়ে করা বেঙ্গল ফাউন্ডেশন প্রযোজিত ছবিটি- (ছবিটির নামটা দিতে হবে)। আমার বিবেচনায় এই ট্রিটমেন্টটা এই ছবিতে ডিজাসট্রুয়াস হয়েছিল। এখানে আমি রিয়েলিটির সরাসরি রিপ্রেজেন্টেশন কিভাবে উনার ছবিতে আসছে সেটা ভিজ্যুয়ালি দেখাতে চেয়েছি- যেহেতু উনার আঁকা ছবি ওরকম। ওটা দেখাতে যেয়ে হাস্যকর একটা ট্রিটমেন্ট করেছিলাম। কিন্তু শিল্পী রফিকুন্নবীকে নিয়ে করা স্মৃতির ঠিকানা। যেখানে আবার ওই অভিজ্ঞতা একটু অন্যভাবে কাজে লাগিয়েছি। তার ফলে উনার সোর্স অব ইন্সপিরিশন কমবেশি এসেছে কিন্তু ঠিক সরাসরি উদাহরণ হিসেবে আসে নাই। রিয়েলিটি ইমেজকে পাশাপাশি রেখে স্ক্রিনে জাক্সটাপোজ করেছি তার পেইন্টিং। তার ফলে জিনিসটা অনেক বেশি করে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। এই চেষ্টাগুলো ভিজ্যুয়ালি একটু অন্যভাবে কিভাবে করা যায় সেটা একটা চেষ্টা করা হয়েছিল। সাকসেসফুল যদি পুরোপুরি হতে পারতাম তাহলে তো সেটা ভালো জিনিসে পরিণত হতো।
যে জিনিসটা আসলে বলতে চাই, আমি এক্সপেরিমেন্টল ছবি কখনো বানাতে চাই নাই। আমার সব সময়ই মনে হয়েছে প্রথাগত চলচ্চিত্র ভাবনা থেকে যদি একটু অন্যভাবে ভাবা যায়। অন্যভাবেও হয়ত একই কাজ করা যায়। করে দেখা যেতে পারে। কিন্তু একদম যারা এক্সপেরিমেন্টাল ছবি বানিয়েছেন- পিওর এন্ড সিম্পল ভিজ্যুয়াল এক্সারসাইজ, কোনো থিম নিয়ে কাজ করেননি, কোনো বক্তব্যও না, কোনো গল্পও না, কোনো প্লটও নাই- সেই ধরনের ছবি বানাতে চাই নাই। কারণ আমার সবসময়ই মনে হয়েছে, আমাদের ছবিগুলো তো একটু ভিন্ন ধারার ছবি- “প্রামাণ্যচিত্র”। তার প্রতি দর্শকের এক ধরনের অনীহা আছে। আগ্রহ কম। তারপরে যদি আবার ওই ধরনের এক্সপেরিমেন্টে যাই তাহলে দর্শকগোষ্ঠিটা অনেক ছোট হয়ে আসবে। আরেকটা ব্যাপার, আমার চলচ্চিত্র ভাবনার সাথে রাজনৈতিক-সামাজিক ভাবনা যুক্ত। সুতরাং আমি নিরীক্ষাধর্মী চলচ্চিত্র করব যেটা সেই মানুষের জন্য যারা কেবলমাত্র এই মাধ্যম নিয়ে চিন্তিত- সেটা আমি করতেও চাই নাই। এটা আমি পারব কিনা, সেই ক্ষমতা আমার আছে কিনা সে সম্পর্কেও আমি নিশ্চিত নই। আমি চাই অনেক বেশি দর্শকের সাথে কমিউনিকেট করতে। কমিউনিকেট করার মধ্যদিয়ে নতুনভাবে কি করা যায় সেটা করার চেষ্টাটা আমি করার চেষ্টা করেছি।

ফৌজিয়া: তার মানে কি রাজনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতা আপনাকে বেশি ভাবায়?
মানজারেহাসীন: আমি মনে করি একেক দেশে একেকটা মাধ্যমের ভূূূূূূূূমিকা- মানে প্রাইমারি ভূমিকা থাকে। আমাদের দেশে সুস্থধারার চলচ্চিত্রের প্রধান ভূমিকা হচ্ছে আমাদের রাজনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতাকে তুলে ধরা। আমি মনে করি সুস্থ ধারার, শিল্পমানসম্পন্ন চলচ্চিত্রের এটা প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। কারণ আমরা এমন একটা সোসাইটিতে বাস করি যেখানে মানুষের প্রাথমিক চাহিদাগুলো এখনও পূরণ হয়নি। সুতরাং চলচ্চিত্র মাধ্যমে শুধুমাত্র শৈল্পিক চর্চা এটা আমি মনে করি না বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিছু মানুষ এটা করতে পারেন- আমি সাধারণ অ্যাপ্রোচটার কথা বলছি। আবার চলচ্চিত্র মাধ্যমকে কেবলমাত্র বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার মানে জনবিনোদন- এটাকে আমি চলচ্চিত্রের প্রধান কাজ বলে মনে করি না। সুতরাং রাজনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতার তুলে আনা আমাদের দেশের চলচ্চিত্রের একটা প্রধান কাজ বলে মনে করি। যাতে করে আমাদের এক্সপেকটেড রিয়েল ইমেজ মানুষের সামনে আসে এবং তার মধ্যদিয়ে মানুষ আমাদের দেশটাকে, আমাদের চারপাশের সমাজটাকে, আমাদের অভিজ্ঞতাগুলোকে যাচাই-বাছাই করতে পারে। ঠিক মিরর সামনে তুলে ধরা না- কিন্তু আবার মিররের মতোন একটা জিনিস। মিরর না এই অর্থে যে হুবহু বাস্তবতার প্রতিফলন তো কোনো চলচ্চিত্র হতে পারে না, চাইলেও পারে না; সেটা হবে না। কিন্তু আবার তার মধ্যদিয়ে আমি আমার নিজের সমাজটাকে দেখতে পারছি কিনা, কতটুকু পারছি- দেখার মধ্যে নতুন কোনো ভাবনা সঞ্চারিত হচ্ছে কিনা সেটা খুব ইমপরট্যান্ট। চলচ্চিত্রের ভূমিকা এটা হওয়া উচিত বলেই মনে করি। সেটা আমি আমার চলচ্চিত্র বা অন্য যে কোনো কাজ করি না কেন তার মধ্যদিয়ে সেটা করার চেষ্টা করি। এটাও একটা কারণ যে আমি প্রামাণ্যচিত্র মাধ্যমটাকে বেছে নিয়েছি। অনেক ধরনের চলচ্চিত্র আছে- নিউ রিয়ালিস্টিক ধারার চলচ্চিত্র অনেক বেশি করে বাস্তবতাকে চলচ্চিত্রের মধ্যে নিয়ে আসে, কাহিনীচিত্রের মধ্যদিয়েও সেটা হতে পারে। কিন্তু প্রামাণ্যচিত্রের মধ্যদিয়ে বাস্তবতাকে মানুষের সামনে নিয়ে আসার সুযোগটা বেশি থাকে আরকি।

ফৌজিয়া: সাক্ষাতকারের একটা পর্যায়ে বলছিলেন, চলচ্চিত্র নির্মাণের শ্যুটিং-পর্ব আপনি বেশি উপভোগ করেন। মানুষের সঙ্গে ইন্টার‌্যাকশনটা ভালো লাগে। আবার সম্পাদনার সময়, ছবিতে সাবজেকটিভ ন্যারেশন তৈরি করার চেষ্টা করেন। তো ছবি বানানোর এই পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে কি নিজের সাথেও এক ধরনের ডায়ালগ হতে থাকে?
মানজারেহাসীন: প্রামাণ্যচিত্রের তো নানা ধরনের ধারা এত বছরে তৈরি হয়েছে। আমি খুব কমফরটেবল ফিল করি দুটো মোড অব ডকুমেন্টারি এক্সপ্রেশনে। একটা, যাকে অনেকে বলছে ‘পার্টিসিপেটারি মোড’। এটা এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়- যে বাস্তবতাকে আমি দেখব সেটা ফিল্মমেকার এবং তার সাবজেক্টের মধ্যে ভাব-বিনিময় তারই একটা নির্যাস। এটা ‘এক্সপোজেটরি মোড’-র মতন না যেখানে ফিল্মমেকারই সুপ্রীম; ফিল্মমেকার যা দেখাচ্ছে তা-ই আপনাকে দেখতে হবে। আবার এটা ‘অবজারভেটরি মোড’-র মতনও না যেখানে চলচ্চিত্র নির্মাতা কেবল দর্শক- তিনি যা দেখলেন তা-ই দর্শকের কাছে তুলে ধরলেন। আমি নিজ এই জায়গায় দাঁড়াতে চাই না। যেটা বলছিলাম যে আমি চিত্রগ্রহণ পর্বটাকে বেশি এনজয় করি এই কারণে যে তখন ইন্টার‌্যাকশনের সুযোগটা পাই। প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের মধ্যদিয়ে ছবির যে বাস্তবতা তাকে অনুভব করি বা ওই বাস্তবতার মধ্যে আমি ঢুকতে চাই। সেটা ব্যাক্তি হউক, পরিবেশ হউক বা স্থানই হউক। এই ইন্টার‌্যাকশনটা আমার জন্য জরুরি। সেই কারণেই আমার বেশিরভাগ ছবিতেই একটা সাবজেকটিভ ডায়মেনশন থাকে- কোনো না কোনো ফর্মে এটা থাকে। অনেক সময় কিছু কিছু সাবজেকটিভ শট থাকে। প্রায় সব ছবিতেই এক ধরনের পয়েন্ট অব ভিউ শট। নট ন্যাসেসারিলি ঠিক ওই শটটির আগেই যে মানুষকে দেখানো হয়েছে তার পয়েন্ট অব ভিউ শট। জার্নির মতোন দুই একটা শট থাকে। এটা সচেতনভাবে করেছি, আবার অবচেতনভাবেও হয়েছে। দেখা গেছে, শুটিংয়ের সময় ওই রকম কিছু শট নিয়ে রাখি যা এডিটিংয়ের সময় ব্যবহার করা হয়ে যায়।
ইদানিং অন্য ধরনের কিছু করার চেষ্টা করছি। কিন্তু এখানে বড় সমস্যা হচ্ছে যে আমার নিজের লেখার হাতটা অত ভালো না। পার্টিসিপেটরি মোডে অনেক বেশি করে ডায়ালগটাকে প্রমোট করা- না হলে তো পার্টিসিপেশন হবে না। তাহলে ইন্টারভিউ-ই এই ডায়ালগ-র একটা উপায়। ইন্টারভিউ মানে আমি প্রশ্ন করলাম আর আরেকজন উত্তর দিলো- সেটা না। ইন্টারভিউ হবে সাবজেক্টকে প্রাধান্য দিয়ে একটা ডায়ালগ ওপেন করা। ইন্টারভিউ কিন্তু সব সময় আকর্ষণীয় না-ও হতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেটা হয় না দুটো কারণে; একটা হচ্ছে, আমরা যারা ইন্টারভিউ নিই তারা খুব যোগ্যতার সাথে সেটা করতে পারি না। কোনো এক ফিল্মমেকারের লেখা পড়ছিলাম- উনি বলছেন, ইন্টারভিউ যদি শট না হয় তবে সেই ইন্টারভিউ চলচ্চিত্রের জন্য আকর্ষণীয় হতে পারে না। কথাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। শটে তো আমরা ভিজ্যুয়ালটা দেখি, কালার দেখি, কম্পোজিশন দেখি, লাইট এন্ড শেড দেখি। ইন্টারভিউ যদি কেবল কথা হয় তাহলে সেটা কখনোই সেই জায়গায় যেতে পারে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইন্টারভিউটা আমরা ওইভাবে করি- ইটস নট অ্যা শট, ইট বেসিক্যালি ইজ গিভিং সাম ইনফরমেশন অর এক্সপ্লেইনিং সাম পয়েন্টস। আর অনেক ক্ষেত্রেই যাদেরকে আমরা ইন্টারভিউ করি তারা ওরালি অতটা এক্সপ্রেসিভ নন। তার ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইন্টারভিউটা বিরক্তিকর উপাদানে পরিণত হয়।
আরেক ধরনের ছবি- যাকে এসেইস্টিক (রচনাধর্মী) বলছে, যেটা আবার ডকুমেন্টারিও না। সেখানে অনেক বেশি করে ফিল্মমেকার উপস্থিত। আমি ফিল্মমেকিং প্রসেসটাকে হাইড করতে চাই। সুতরাং আমার জন্য নেচারাল প্রসেস হচ্ছে আইদার পার্টিসিপেটরি মোডে থাকা যেখানে এজ অ্যা ফিল্মমেকার আমি এবং ছবিতে আমার সাবজেক্ট বা চরিত্রের ইন্টার‌্যাকশনের ফলাফলটা দর্শক দেখবে। অথবা আমার একান্ত সাবজেকটিভ ভিউটাই বেছে নেয়া। আর সেটা যদি করতে চাই তবে দুইভাবে হতে পারে- একটা হচ্ছে পিওর ভিজ্যুয়াল এক্সারসাইজের মধ্যে যাওয়া- সেটা খুব কেয়ারফুল সিলেকশন অব শটস হতে পারে। আরেকটা হতে পারে, ভিজ্যুয়ালকে ডেফিনিট ইন্টারপ্রিটেশনের দিকে নিয়ে যাওয়া। ইন্টারপ্রিটেশন আমি এভাবে করতে পারি এজ ফিল্মমেকার, আপনি ওভাবে ইন্টারপ্রিট করতে পারেন, আরেকজন ওই ভিজ্যুয়াল দেখে আরেকভাবে ইন্টারপ্রেট করবে। ক্রিস মার্কার (মার্কিন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা) এই ধরনের ছবি শুরু করেছিলেন। এখন এটা আরো অন্য জায়গায় চলে গেছে। ক্রিস মার্কারও আর আগের জায়গায় নাই। ওইধরনের ছবির প্রতি আমার একটা আকর্ষণ আছে। আমার ইচ্ছা আছে ওই ধরনের একটু চেষ্টা করে দেখা।
আমার একটা পরিকল্পনা আছে যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ফুটেজগুলোকে এই ধরনের একটা ইন্টারপ্রেটিভ মোডে এক্সপ্লেইন করব। এটার সাথে কোনো ইন্টারভিউ বা কমেট্রি টু প্রভাইট সাম ইনফরমেশন- এইগুলো কিছুই থাকবে না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের যে ছবি মানে ফুটেজ সেগুলো বহুল ব্যবহৃত, ছবির সংখ্যা কম। নতুন ছবিও আমরা সংগ্রহ করতে পারছি না এবং আছে কিনা তাও জানি না। কিন্তু যেগুলো আছে আমাদের কাছে সেগুলোকে আমরা একটু স্টেরিওটাইপ করে ফেলেছি। এর একটা উদাহরণ আপনাকে দেই, খুব ছোট উদাহরণ। এই ট্রিটমেন্টগুলো আমি কিছু কিছু চেষ্টা করেছি খুব ছোট আকারে। আমার চারুশিল্পে মুক্তিযুদ্ধ যে ছবিটা- তার শুরুতে বঙ্গবন্ধুর সাত মাচের্র ভাষণের ভিজ্যুয়ালের ওপর আমি নির্মলেন্দু গুণের একটা কবিতার অংশের পাঠ ব্যবহার করেছি। শেষে যখন বঙ্গবন্ধু বলেছেন- এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম- ভিজ্যুয়ালটা ওটাই আছে কিন্তু আমি গুণের কবিতার পাঠ ব্যবহার করেছি। ওই কথাই কবিতায় লেখা এবং আকস্মিকভাবে কবিতা বন্ধ করে গুলির শব্দ ব্যবহার করেছি। মনে হতে পারে- এতে নতুন আর কী হলো! কিন্তু আমি অন্যভাবে একটু দেখতে বলি। সাতই মার্চের ওই দৃশ্যটি আমার বার বার দেখি- আমার দেখা টেলিভিশন প্রোগ্রাম কিংবা সিনেমা সবখানেই কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাষণের দৃশ্য মূল সাউন্ডট্র্যাকসহই ব্যবহার করতে দেখছি। ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে ব্যবহার করা স্বাভাবিক, সত্য, বাস্তব। এই সত্য এবং বাস্তবকে যখন নির্মলেন্দু গুণের লেখা কবিতা থেকে পাঠ হিসেবে ব্যবহার করি আমি তখন কিন্তু একটা পার্থক্য তৈরি হয়। এই পার্থক্যটা কি? এটা আসলে সাবজেকটিভ ইন্টারপ্রিটেশন। এটা রিয়েলিটিকে ডিসটর্ট করছে না। আমার ধারণা এই সাবজেকটিভ ইন্টারপ্রিটেশন রিয়েলিটিকে আরো পোক্ত করেছে। একই ইমেজ দেখতে দেখতে একঘেয়েমি তৈরি হয়েছে- ওটা আর আমাদের মধ্যে কোনো আবেগ সৃষ্টি করে না। কিন্তু সাত মার্চের ভাষণ আমাদের মধ্যে আর কোনো আবেদন সৃষ্টি না করলে আমরা কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকে ভুলে যেতে বসব। সুতরাং এর ৎবারঃধষরুধঃরড়হ দরকার আছে। এই জন্যে ইন্টারপ্রিটেশনকে যদি জেনারেল ফর্মে আনা যায় তাহলে হয়তো সেটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে।

ফৌজিয়া: ইন্টারপ্রিটেশন মনে আপনার সাবজেকটিভ ইন্টারপ্রিটেশন?
মানজারেহাসীন: হা, সাবজেকটিভ তো বটেই। প্রত্যেক মানুষের তো সাবজেকটিভ অভিজ্ঞতাই সবচেয়ে বড় অভিজ্ঞতা। আমরা যখন একটা ফিল্ম দেখি, একটা ফটোগ্রাফ দেখি, গল্প পড়ি, উপন্যাস পড়ি তখন আমাদের ব্যক্তিগত চিন্তা-অভিজ্ঞতা-অনুভূতির মিল খুঁজতে চেষ্টা করি। ব্যক্তিগত মিল খুঁজে পেলেই আমরা খুব এক্সাইটেট ফিল করি। আমরা কিন্তু একেবারে নতুন একটা আইডিয়ার সাথে পরিচিত হতে খুব কমফরটেবল ফিল করি না। বরঞ্চ আমরা আমাদের অভিজ্ঞাকে আরেকটু ঝালাই করে নিতে চাই। ইন্টারর‌্যাকশন উইদ দ্যা সাবজেক্ট আমি করি- আমার ওদিকেই ঝোঁক, ওটা আমার ভালো লাগে; সুতরাং আমি ওইরকমভাবেই ছবিতেও তা-ই করতে চাই।

ফৌজিয়া: আপনার অভিযাত্রী বেশ লম্বা- দেড় ঘণ্টার উপরে। একবার আপনি বলছিলেন, আপনি ফিচার লেঙথ প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করতে চান। কাহিনীচিত্রের সাথে দৈর্ঘ্যের দিক থেকে একরকমের প্রতিযোগিতার জায়গা থেকেই এটা করতে চান?
মানজারেহাসীন: হাহ, হাহ, হাহ (হাসি)! না, কাহিনীচিত্রের সাথে দৈর্ঘ্য নিয়ে কোনো প্রতিযোগিতার ব্যাপার নেই। আমাদের দেশে এটা ধরেই নেয়া হয় যে প্রামাণ্যচিত্র হবে স্বল্পদৈর্ঘ্যরে। এর পেছনে মনস্তাত্তি¡ক কারণ হলো যে, প্রামাণ্যচিত্র এতক্ষণ মানুষ দেখবে না। ধরেই নেয়া হয়, প্রামাণ্যচিত্র এমন কিছু দেখায় না যা মানুষের আকর্ষণকে লম্বা সময় ধরে রাখতে পারে। ফিকশনের জন্যে কিন্তু এর উল্টোটা চিন্তা করে। শর্ট ফিকশন হলে ওটাকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনে না। আমাদের সাধারণ চিত্রটা কিন্তু এরকমই। এইজন্যে এটা আমার সবসময় মনে হয়, যে এমন কোনো সাবজেক্ট ডিল করা যায় কিনা যেটা লম্বা দৈর্ঘ্য ডিমান্ড করে তাহলে হয়তো প্রামাণ্যচিত্র বিষয়ে এই ট্যাবুকে নাড়া দেয়া যেতে পারে। এটা একটা বিষয়। আরেকটা বিষয় হলো, আমি ফিল্মকে মানে যেকোনো ফিল্মকে টেলিভশনের বেঁধে দেয়া সময়সীমার মধ্যে বাঁধতে চাচ্ছি না। ফিল্মের আলাদা জায়গা তৈরি হতে হবে। এখন পোস্ট-টেলিভিশন ফিল্ম হতে হবে। যেকোনো দৈর্ঘ্যের প্রামাণ্যচিত্র হতে পারে- এটা কাহিনীচিত্রের দৈর্ঘ্য হওয়া ভালো এই কারণে যে এই দৈর্ঘ্যের ছবি দেখার অভিজ্ঞতা দর্শকের আছে। তৃতীয়ত, আপনি সেরকম একটা সাবজেক্ট নেন- যে সাবজেক্ট নিজে বেশ লম্বা একটা সময়, বড় একটা জায়গা চায়- তাহলে আপনি কেন সেটা দেবেন না তাকে? হেনা দাসকে নিয়ে নির্মিত ফিচার লেঙথের প্রামাণ্যচিত্র অভিযাত্রীকে আমার দর্শকরা কিন্তু লম্বা বলেন নাই। অকারণে লম্বা ছবি- এটা খুব বেশি লোক বলে নাই। হেনা দাসের জীবন নিয়ে ছবি করতে গিয়ে যতটা সময় ছবিটিকে দিতে হয়েছে আমি দিয়েছি। কারণ, আমি বায়োগ্রাফিক্যাল ছবি বানিয়েছি। জীবনীভিত্তিক ছবি বানাতে গিয়ে কখোনো মনে হয় নাই যে দিন-ক্ষণ এই জাতীয় তথ্যে সমৃদ্ধ ছবি বানাতে হবে। আমি এক জায়গায় পড়েছিলাম, আসলে প্রতিটি মানুষের একটা ইতিহাস থাকে, সেই ইতিহাস আবার জাতীয় এবং বৈশ্বিক ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠে। কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে এটা অনেক বেশি করে, আবার কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে এটা অতটা দৃশ্যমান নয়- কিন্তু খুঁজতে চাইলে সেখানেও সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসকে পাওয়া যাবে। এনারা মানে হেনা দাসরা হচ্ছেন সেই ধরনের মানুষ যাদের জীবনের মধ্যদিয়ে সেই সময়ের প্রতিচ্ছবি আপনি পাবেন। তাদের জীবন শুধু ব্যক্তি মানুষের ইতিহাস না। আপনি যদি অভিযাত্রী ছবিটি দেখেন তাহলে দেখবেন ব্যক্তিমানুষ অত প্রমিন্যান্ট নন- তারচেয়ে বেশি করে এসেছে তার সেই সময়টা। এটা কিন্তু ইতিহাসের পাঠ। ব্যক্তি মানুষের মধ্যদিয়ে ইতিহাসের একটা সময়কে পাঠের একটা চেষ্টা। জীবনীভিত্তিক ছবির একটা সুবিধা কী জানেন? একটা কাঠামো আপনি পেয়ে যান। একজন মানুষের জন্ম আছে, কর্ম আছে- এটা বিখ্যাত মানুষ হতে হবে এমন না। মানুষের জীবনে তো নানান ধরনের বিষয় থাকে। সেই বিষয়গুলোর ভিতর দিয়ে, মানুষটাকে জানার ভেতর দিয়ে সমাজ-ইতিহাস-সময়কে আমরা জানতে পারি। চলচ্চিত্রের সেই সুবিধাটা আছে। একটা ফটোগ্রাফ বা পেইন্টিংয়ে অনেককিছু আপনাকে ভেবে নিতে হবে। চলচ্চিত্রে আপনি যা বলতে চান বা যে ভাবনাটা দর্শককে দিতে চান তা দেখাতে পারেন। এইভাবে ইন্ডিভিজ্যুয়ালের মধ্যদিয়ে তার সময়টাকে দেখা, সময়ের জাতীয় ইতিহাসকে দেখার একটা সুযোগ চলচ্চিত্রে তৈরি হয়। রোকেয়াতেও কিন্তু সেটাই আছে বেশি করে। ব্যক্তি রোকেয়ার চেয়ে তাঁর জীবনকালের সময়ের ছবি অনেক বেশি এই ছবিতে। ওনার ব্যক্তিজীবন পাওয়াও খুব সহজ নয়। আর দিন-ক্ষণের তথ্য দিয়ে ছবি তৈরি করার চেষ্টাও আমি করিনি। হেনা দাসকে নিয়ে করা ছবিটাতেও দিন-ক্ষণের তথ্য নাই।

ফৌজিয়া: কৃষ্ণনগরে একদিন নিয়ে কোনো কথা হলো না।
মানজারেহাসীন: ওটা তো একটা ওয়ার্কশপ প্রযোজনা। নানা মানুষের আইডিয়া নিয়ে কাজ করা। ওয়ার্কশপের পরিচালনা উপদেষ্টাই ছিলেন প্রধান ব্যক্তি। তার অধীনে ওয়ার্কশপ মানে তার চলচ্চিত্র ভাবনাটাই প্রাধান্য পেয়েছে। কৃষ্ণনগরে একদিন করার সময় আমরা দীর্ঘ সময় একটি সম্প্রদায়কে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। উনি যে ভাষায় যে স্টাইলে চলচ্চিত্র বানান, সেটা আমাদের তিনি দিয়েছিলেন। কিন্তু বিষয়টা ওনার খুব জানা ছিল না- ওটা আমরা জানি, আমাদের দেশের বিষয়। সুতরাং ওনার চলচ্চিত্র ভাষা আর আমাদের বিষয় সম্পর্কে জানাশোনার ব্যাপারটা বেøন্ড করার একটা চেষ্টা আমরা করেছিলাম। আমরা উনার ধারায় ছবিটা নির্মাণ করেছিলাম। আমাদের দেশে এই ধারায় প্রামাণ্যচিত্র হওয়া উচিত। এই ধারা বলতে নৃতাত্তি¡ক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একটি সম্প্রদায়কে দেখা। এটা কিন্তু প্রামাণ্যচিত্রের একটা বিশাল ধারা। এই ধারায় আমাদের দেশে খুব বেশি ছবি আমরা বানাই নাই- হলেও খুব ছোটোখাটো কিছু কাজ হয়েছে। ইত্তিগুলা চাঙামার ছবিটা (ছবির নাম দিতে হবে……………) কিংবা সাঁওতাল কমিউনিটি নিয়ে দু’একটা কাজ । এদিক থেকে কৃষ্ণনগরে একদিন বেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ ছবি বলব। এর ক্যামেরা এবং সঙ্গীত ব্যবহারে এক ধরনের মিনিমালিজম আছে। আমার কাছে ইদানিং মিনিমালিস্ট অ্যাসথেটিকসকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। কথাটাকে এরকমভাবে বলা যায় যদি- সিম্পল ইউদ এলিগেন্স। ক্যামেরা কত জায়গায় বসল, কত জায়গায় ঘুরল, কত চমকপ্রদ ইমেজ আমি তৈরি করতে পারলাম- সেটা এখন আর আমার কাছে এক্সাইটিং মনে হয় না। বয়সের কারণেও হতে পারে এটা। তবে ছবিকে যদি সাদামাটা কিন্তু ওই যে থাকে না যে এক ধরনের এলিগেন্স- এলিগেন্সের বাংলা কি? মানে এক ধরনের অ্যারিস্টোক্রেসি অব ইমেজ আমি দেখতে চাই আমার ছবিতে।

ফৌজিয়া: ‘অ্যারিস্টোক্রেসি অব ইমেজ’ বলতে আসলে কি বোঝাতে চাইছেন আপনি?
মানজারেহাসীন: ইমেজের শক্তি আমি দেখাতে চাই এবং এই শক্তিটা কিন্তু দৃশ্যের সৌন্দর্য না- ভিজ্যুয়াল বিউটি না। এটা পোস্টকার্ডের সৌন্দর্য না। পোস্টকার্ডে সাধারণত বিভিন্ন দেশের সুন্দর ইমেজ দেখি আমরা এবং ওই ইমেজ খুব চকচকে, ঝকঝকে কখনো। কিন্তু ওই ইমেজ আসলে হয়তো সেসব দেশের রিয়েলিটির প্রতিনিধিত্ব করে না। চলচ্চিত্র যেহেতু অনেক বেশি প্রত্যক্ষ, সেই জন্যে কেবলমাত্র বিউটিফিকেশন করা কঠিন। দৃশ্যায়ণের মধ্যদিয়ে বিউটিফিকেশন নয়- বিউটিকে দেখার চেষ্টা করাটাকেই আমি অ্যারিস্টোক্রেসি অব ইমেজ বলতে চাই। বিউটি দেখতে গেলে কিন্তু ইউ নিড টাইম। পর্যবেক্ষণের সময় দিতে হবে। অপ্রয়োজনীয় ক্যামেরা মুভমেন্ট, অড অ্যাঙ্গেলস- প্রয়োজন নয় কিন্তু চমক দেখানোর জন্য ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল- এইগুলো কিন্তু ছবির বিষয়কে ডিসটর্ট করে, ডিসটার্ব করে। মেডিটেটিভ দিকে যদি দর্শককে নিয়ে যাওয়া যায় সেই চেষ্টা আমাদের করতে হবে। এই কারণে আমি টেলিভিশনের ইমেজ থেকে চলচ্চিত্রের ইমেজকে আলাদা করি। আমার মনে হয় সিনেমার ইমেজ অনেক বেশি করে মেডিটেটিভ হওয়ার দরকার এবং সম্ভবও সেটা। সিনেমার ইমেজের সেই কোয়ালিটি থাকা দরকার। টেলিভিশনের ইমেজে বেশি করে যেটা আছে সেটা হলো বাস্তবের উপস্থিতি। কিন্তু তার নান্দনিক উপস্থাপনা নাই বললেই চলে। কারণ ওই সময়টা দিতে পারে না টেলিভিশন। তার প্রয়োজনও নাই সেখানে। বিদেশি টেলিভিশনগুলো যেমন এমটিভির যে স্টাইল- একটা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আপনি অবাক হবেন, বিস্মিত হবেন, আপনি যে সেটাকে ভালো করে আত্মস্থ করতে চাইবেন- এই সময়টা আপনাকে দিবে না। সিনেমাই কেবল এমন মেডিটেটিভ ইমেজ আপনাকে দিতে পারে। সিম্পল বাট এলিগেন্ট। একই সাথে মেডিটেটিভ। একেই আমি ‘অ্যারিস্টোক্রেসি অব ইমেজ’ বলতে চাইছি।

ফৌজিয়া: এখন কি কোনো ছবি করছেন?
মানজারেহাসীন: আমি এখন একটা ছবির কথা ভাবছি যেটা খুবই ন্যারেটিভ। কয়েকটি চরিত্র। তাদের প্রত্যেকের পারসোনাল স্টোরিজ। কাজটা এখনো পুরোপুরি আকার ধারণ করেনি। এটা নিয়ে আপাতত বেশিকিছু বলছি না।

ফৌজিয়া: আমরা তাহলে আজকের মতোন শেষ করি। ধন্যবাদ আপনাকে।
মানজারেহাসীন: ধন্যবাদ।

[কথোপকথনটি ২০১২ সালের শুরুর দিকে ধারণ করা হয়। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা দীর্ঘ কথোপকথন। এর কিছু নির্বাচিত অংশ শিল্প ও শিল্পীর ………..তম সংখ্যায় প্রথমবারের মতোন প্রকাশিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আয়োজিত চলচ্চিত্র উৎসবের ব্রশিয়রেও কথোপকথনের ডিজিটাল প্রযুক্তি প্রসঙ্গটি ছাপা হয়েছে। এবারও এই কথোপোকথনের পুরোটা দেয়া গেল না। তবে এখানে বেশির ভাগটাই আছে।
……………ফৌজিয়া খান]